গাজীপুরে গ্যাস বিস্ফোরণ
সুজিত সরকার, সিরাজগঞ্জ ও তাহছিন নূরী খোকন, শাহজাদপুর
প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:২৯ পিএম
আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:৩৩ পিএম
দাদি সাহানা খাতুনের কোলে বাবার অপেক্ষায় থাকা শিশু সাজিদ। প্রবা ফটো
ঈদে বাবা নতুন জামা আনবেন। মা আনবেন খেলনা। সেই আশায় পথ চেয়ে আছে তিন বছরের শিশু সাজিদ। বাড়ির বাইরে কোনো গাড়ির শব্দ পেলেই ছুটে যায়, এই বুঝি বাবা-মা এলেন। অবুঝ শিশুটি এখনও জানে না তার এ আশা কোনো দিনই পূরণ হওয়ার নয়। নির্মম বাস্তবতায় রুদ্ধ হয়ে গেছে সে পথ। ১৩ মার্চ গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ছোট সাজিদের বাবা মহিদুল খাঁ ও মা নার্গিস খাতুন দুজনেই এখন না ফেরার দেশে। বয়োবৃদ্ধ দাদা-দাদির ভাঙা ঘরটিই এখন তার শেষ আশ্রয়। সামনে ঈদ। কিন্তু সেখানে নেই কোনো আনন্দ। বরং থেমে থেমে গুমরে ওঠে শোকের মাতম। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে সিরাজগঞ্জের যে ৬ জন নিহত হন তাদের ৫ জনের বাড়িই শাহজাদপুর উপজেলার গালা ইউনিয়নে।
৩ এপ্রিল বুধবার সরেজমিনে গিয়ে সবার বাড়িতেই প্রায় একই অবস্থা দেখা যায়। পারিবারিকভাবে অসচ্ছল এই পরিবারগুলোর পাশে বেসরকারিভাবে কেউ কেউ এগিয়ে এলেও সরকারি পর্যায়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো সহযোগিতা পায়নি তারা।
শিশু সাজিদের বাবা মহিদুল খাঁ ও মা নার্গিস খাতুন দুজনেই কালিয়াকৈরে গার্মেন্টসে কাজ করতেন। ছেলেকে রেখেছিলেন দাদা-দাদির কাছে শাহজাদপুরের বেড়াকোল গ্রামের খাঁ পাড়ায়। বয়োবৃদ্ধ দাদা সাবেদ খাঁ (৭০) ও দাদি সাহানা খাতুন (৬৫) নাতিকে নিয়ে খুব খারাপ ছিলেন না। ছেলে, ছেলের বউ যে টাকা পাঠাতেন, তাই দিয়ে সংসার চলত। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মানুষটি কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন অনেক আগেই। কিন্তু সিলিন্ডার দুর্ঘটনার পর বুকে শোকের পাথর বেঁধে এই বৃদ্ধ বয়সে আবার দিনমজুরের কাজ নিতে হয়েছে। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, সংসার তো চালাতে হবে, তার ওপর ছোট নাতিটা আছে। খামু কী?
এই এলাকার খাঁ পাড়ায় দেখা হয় সাজিদের সঙ্গে। দেখা যায় টিনের একটি ঘরে দাদা-দাদির সঙ্গে সাজিদ। ঘরের চাল থাকলেও নেই জানালা। ঘরে আসবাবপত্র বলতে একটি মাত্র চকি। দাদির কোলে মন ভার করে আছে সাজিদ। সাজিদের দাদা কাজের খোঁজে গিয়েছেন। বৃদ্ধ দাদি অশ্রুসিক্ত হয়ে দরজার কোনায় সাজিদকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। কথা হয় দাদি সাহানা খাতুনের সঙ্গে। তিনি জানান, নাতি বারবার শুধু বাবা-মায়ের কথা বলে। ও বলে ঈদে বাবা আসবে আমার জন্য মাংস নিয়ে আসবে। মা আমার জন্য খেলনা আনবে। আরও কত কী। আমি তখন মুখ লুকিয়ে কাঁদি। ছোট বাচ্চাটা তাই দেখে দূরে গিয়ে মন ভার করে বসে থাকে। প্রতিবেশী অনেক ছোট ছেলেমেয়ে সাজিদকে বলে তোর বাবা-মা মারা গেছে। এ কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে দৌড়ে আসে। বাবা-মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে। ছোট এই অবুঝ শিশুকে নিয়ে আমি কী করব।
এখানে কথা হয় প্রতিবেশী রমজান খাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, এই পরিবারটা খুবই অসচ্ছল। ছেলের মৃত্যুর পর নাতিকে নিয়ে কোনোমতে দিন পার করছে। ঈদের আনন্দ আর কী, ঠিকমতো ইফতার করতে পারেন না। গতকাল পানি দিয়ে ইফতার করেছেন শুনেছি।
একই গ্রামের হালদারপাড়ার সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নিহত সোলায়মান মোল্লার পারিবারিক অবস্থাও একই রকম। নিহত সোলায়মানের স্ত্রী শাপলা খাতুনের এখন দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সংসার। স্বামীর মৃত্যুর পর একটি ছোট ঘরে তিন সন্তান আর শাশুড়ি সুকজান খাতুনকে নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। সোলায়মান তার ছোট ভাই উজ্জ্বল মোল্লার স্ত্রী শিল্পী খাতুন ও তার দুই সন্তান নিরব ও নূরনবীকে বাঁচাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় নিহত হযন। শিল্পী খাতুন ও নিরব এখনও ঢাকায় শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি রয়েছে। পায়ে পোড়ার ক্ষত নিয়ে নূরনবী শাপলা খাতুনের কাছেই রয়েছে।
শাপলা খাতুন (৩৭) জানান, তার স্বামী সোলায়মান মোল্লা ছিলেন শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। ঠিকমতো হাঁটতে পারতেন না তিনি। কালিয়াকৈরে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন। আমি অন্যের বাসায় কাজ করতাম। ঘটনার দিন ভাইয়ের বউকে বাঁচাতে গিয়ে তার শরীরে আগুন লেগে যায়। ঘটনার পাঁচ দিন পর চিকিৎসারত অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। আমি এখন আমার তিন সন্তানকে নিয়ে অসহায় অবস্থার মধ্যে দিন যাপন করছি। আমার ২২ বছরের সংসার নাই হয়ে গেল। পিতৃহারা হলো আমার তিন সন্তান। এখন আমি তাদেরকে নিয়ে কী করব, কীভাবে চলব? তিনি জানান, ঘটনার পর ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ এগিয়ে এলেও সরকারিভাবে তেমন কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাননি।
এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন সোলায়মানের মা সুকজান বেগম (৬৫)। বিলাপ করে বলে ওঠেন, আমার ছেলে মরার পর তাকে আর চেনা যায়নি। পুরা শরীর আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। আমার ছেলেরে কে ফিরায়া দিবে।
একই এলাকার নিহত কুটি ফকিরের (৩৫) ঘরে এখন তালা ঝুলছে। স্ত্রী দুলু খাতুন (৩০) আর ৩ মেয়েকে নিয়ে সংসার ছিল তার। বাবা আয়নাল ফকির ও মা জরিনা খাতুন অনেক আগেই মারা গেছেন। ঢাকায় দিনমজুরের কাজ করতেন কুটি ফকির আর দুলু খাতুন কাজ করেন গার্মেন্টসে। স্বামীর মৃত্যুর পর এলাকায় এসেছিলেন কিন্তু পেটের দায়ে তিন সন্তানকে নিয়ে আবারও কালিয়াকৈর ফিরতে হয়েছে।
কুটি ফকিরের চাচাতো ভাই সেদেক ফকির বলেন, আমার ভাই দিন এনে দিন খেত। পেটের দায়ে গাজীপুর গিয়ে কাজ করত। সে মরে গেছে, কিন্তু রেখে গেছে স্ত্রী তিন সন্তানসহ। জানি না তাদের ভাগ্যে কী হবে? আমরাও কোনোমতে দিন পার করি। তাই ইচ্ছা থাকলেও তাদের পাশে দাঁড়াতে পারছি না। সরকার যদি তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় তাহলে অন্তত তারা বেঁচে খেয়ে থাকতে পারত।
শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান জানান, নিহতদের তালিকা অনুসারে তাদের কিছু ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কার্যক্রম চালু রয়েছে। অসহায় এ মানুষগুলোর পাশে সরকার এগিয়ে আসবে এমনটাই প্রত্যাশা করছেন এলাকাবাসী।