গাজীপুরে গ্যাস বিস্ফোরণ
মোহন আখন্দ, বগুড়া
প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:১১ পিএম
আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:২২ পিএম
গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত মুনছুর আলীর কন্যা ও স্ত্রী। প্রবা ফটো
‘গত বছর রমজানে মাত্র ৮টি রোজা করেছিলাম। এবার এক রোজাও বাদ দিচ্ছি না- এটা শুনলে আব্বু খুব খুশি হতেন। কিন্তু তাকে তো বলতেই পারলাম না। বলব কীভাবে? দুই রোজার দিন (দ্বিতীয় রমজান) ইফতারের আগে আব্বুর গায়ে আগুন লাগে আর পাঁচ রোজার দিন সকালে তো তিনি মারা গেলেন।’ বলছিল ১১ বছর বয়সি মোহসীনা আকতার।
গত ১৩ মার্চ গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে যে ৩২ জন দগ্ধ হন, তাদের মধ্যে মোহসীনা আকতারের বাবা মুনছুর আলী আকন্দও ছিলেন। ওই বিস্ফোরণে মুনছুর আলীসহ মোট ১৭ জন প্রাণ হারান।
মুনছুর আলী আকন্দের বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার কিচক ইউনিয়নের শালদহ-বাট্টা গ্রামে। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরের ওই গ্রামটি জেলার উত্তরে একেবারে শেষ প্রান্তে। সেখানকার সিংহভাগ মানুষ কৃষিজীবী। মূলত অন্যের জমিতে ফসল ফলিয়েই তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। ৩৬ বছর বয়সি মুনছুর আলীও কৃষিশ্রমিক ছিলেন। তবে ২০০৮ সালে বিয়ের পর বাড়তি আয়-রোজগারের আশায় পেশা বদলে রাজমিস্ত্রির (নির্মাণ শ্রমিক) কাজ নেন। স্ত্রী দীনা বেগমকে বাড়িতে রেখে চলে যান গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায়।
বছর তিনেক আগে দুই কন্যাকে বৃদ্ধ মায়ের কাছে রেখে স্ত্রী দীনা বেগমকেও নিজের কাছে নিয়ে যান মুনছুর আলী। দীনা বেগম চাকরি নেন গাজীপুরের একটি গার্মেন্টে আর মুনছুর আলী ভবন নির্মাণের কাজ করতেন। সারা বছর গার্মেন্টসে কাজ করলেও প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে আলু তোলার মৌসুমে স্ত্রীকে বাড়ি পাঠাতেন। এবারও দীনা বেগম আলু তোলার জন্য বাড়ি এসেছিলেন। বড় মেয়ে পানিতলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী মোহসীনা আকতার এবং ছোট মেয়ে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণিতে অধ্যয়নরত মিনহা খাতুনও মায়ের সঙ্গে আলু তুলেছে।
দীনা বেগম জানান, গত ১৩ মার্চ ইফতারের আগে মুহূর্তে অপরিচিত এক নম্বর থেকে তার ফোন আসে। রিসিভ করতেই একজন বলেন, ‘আপনার স্বামীর শরীরে আগুন লেগেছে, তাকে হাসপাতালে আনা হয়েছে তিনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। এরপর মোবাইলে আমার স্বামী বলতে থাকেন, “আমার খুব খারাপ অবস্থা। তাড়াতাড়ি আস।” দিনা বেগম বলেন, ‘স্বামীর মুখে তার অবস্থা জানার পর আমার হাত-পা যেন অবশ হতে শুরু করে। কোনো রকমে ইফতার মুখে দিয়েই প্রতিবেশী এক ভাতিজা এবং দেবরকে সঙ্গে নিয়ে বের হই। রাত আড়াইটার দিকে হাসপাতালে পৌঁছার পর আগুনে পোড়া অনেক মানুষের ভিড়ে স্বামীকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু তিনি আমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন। আমাকে দেখে বলতে শুরু করেন, “আমিই মুনছুর, তোমার স্বামী।” এরপর থেকে তার সঙ্গেই ছিলাম। আশা ছিল তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু তিন দিন পর ১৬ মার্চ শনিবার সকাল ৬টার দিকে তিনি মারা যান।’
বিধবা মা জোবেদা বেওয়া জানান, চার ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মুনছুর তৃতীয়। অপর তিন ছেলের মধ্যে দুজন কৃষিকাজ করলেও অন্যজন রিকশা-ভ্যান চালায়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে জোবেদা বেওয়া বলেন, যেদিন আগুন লাগে সেদিন দুপুরের দিকে মুনছুর আলী আমাকে ফোন করে বলেছিল, ঈদের ৪-৫ দিন আগেই বাড়ি আসবে। আমার জন্য শাড়ি-কাপড় আনবে বলেও জানিয়েছিল। কিন্তু সেই ছেলে ফিরল লাশ হয়ে।’
প্রতিবেশী ভাতিজা শফিকুল ইসলাম জানান, মুনছুর আলী খুবই গরিব ছিল। বাবার রেখে যাওয়া বসতবাড়ির ৯ শতাংশ জায়গা ছাড়া আর কিছুই নেই। মৃত্যুর পর মুনছুর আলীর লাশ গ্রামে নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ ২০ হাজার টাকা দেয়। সেটি দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে লাশ এনে দাফন করা হয়। এরপর গ্রামবাসীর কাছ থেকে টাকা তুলে তার জন্য মিলাদ করা হয়। মুনছুর আলীর ফুপাতো বোন মাজেদা বেগম জানান, সাংসরিক প্রয়োজনে তার ভাই একটি এনজিও থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিল। মৃত্যুর পর সেটি তারা মওকুফ করে দেয়। তিনি বলেন, ‘ঋণ মওকুফ হলেও ঘরে কোনো খাবার ছিল না। সেজন্য গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে জাকাত-ফিতরা সংগ্রহ করে তাদেরকে দেওয়া হয়েছে। আগামীতে ধান উঠলে হয়তো কিছু সাহায্য করা হবে।’
আরিফ হোসেন নামে অপর এক স্বজন জানান, মুনছুর আলীর বড় মেয়ে মোহসীনা আকতার খুব মেধাবী। ষষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত মোহসীনা ভবিষ্যতে চিকিৎসক হতে চায়। কিন্তু এখন তার পড়ালেখার খরচ কে চালাবে? ছোট্ট ওই মেয়েটির কাছে তার ভবিষ্যৎ ইচ্ছার কথা জানতে চাইলে চোখের কোণে জমা পানি মুছতে মুছতে সে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলে, ‘আমি ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। এটা আব্বুকে বলেওছিলাম। আব্বু আমাকে কষ্ট করে হলেও পড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন তো আব্বু নেই। কী হবে জানি না?’
মুনছুর আলীর স্ত্রী দীনা বেগমের কাছে ঈদের কেনাকাটার কথা জানতে চাইলে তিনি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলেন, ‘এখন কি আমার ঈদ আছে? রোজার দিন বলে অনেকেই তাদের জাকাত-ফিতরা থেকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করছে। ঈদের পর কী হবে? সারা বছরই কি হাত পেতে চলা যায়? তাছাড়া আপনারাই বলেন, অন্যের বাড়িতে কিংবা জমিতে কাজ করে কত টাকাই আর রোজগার করা যায়? সেটা দিয়ে ছোট দুই মেয়েকে খাওয়াব নাকি তাদের পড়ালেখা করাবÑ এসব ভাবলে শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। তাদের নিয়ে লড়াইটা আমার জন্য অনেক কঠিন হয়ে গেলে। জানি না কীভাবে লড়ব?’
শালদাহ-বাট্টা গ্রামের বাসিন্দা সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য খয়বর আলী জানান, মুনছুর আলীর মৃত্যুর পর পাড়া-প্রতিবেশীরা সাহায্য-সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এলেও জনপ্রতিনিধি কিংবা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কেউ অসহায় এই পরিবারটির খোঁজ নিতে এক দিনও আসেননি। তিনি মুনছুর আলীর বিধবা স্ত্রী এবং তার দুই শিশুসন্তানের জন্য সরকারি সহায়তা কামনা করে বলেন, মেয়ে দুটিকে সরকারি এতিমখানায় (শিশু সদন) রাখতে পারলে একদিকে তাদের খাওয়ার কষ্ট যেমন দূর হতো, তেমনি পড়ালেখাও চালিয়ে নিতে পারত।’