এমএ হান্নান, বাউফল (পটুয়াখালী)
প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০২৪ ১২:৫০ পিএম
আপডেট : ০৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:২৩ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
পটুয়াখালীর বাউফলে কয়েক বছর ধরে বাড়ছে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ডাকাতিতে ব্যবহার হয় এসব অস্ত্র। প্রায়ই ঘটছে অস্ত্র প্রদর্শন, ফাঁকা গুলি ও হতাহতের ঘটনা। সম্প্রতি বড় ভাইয়ের অস্ত্রের গুলিতে প্রতিবন্ধী ছোট ভাই নিহত হওয়ার ঘটনায় বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। তবে এসব অস্ত্রে উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা নেই বলে অভিযোগ সাধারণ মানুষের।
থানা পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত মাসের ৯ তারিখে উপজেলার সূর্যমণি গ্রামে বড় ভাই সজীব হোসেনের অবৈধ পিস্তলের গুলিতে নিহত হন ছোট ভাই সাব্বির। নিহত সাব্বির ও অভিযুক্ত সজীব ওই গ্রামের বাবুল সওদাগরের ছেলে। এ ঘটনায় পুলিশ অভিযুক্ত সজীবকে গ্রেপ্তার করেছে। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রান্নাঘরের গাছের শুকনো পাতার বস্তা থেকে গুলিভর্তি বিদেশি রিভলবার (পিস্তল) উদ্ধার করে পুলিশ।
বড় ভাইয়ের গুলিতে ছোট ভাই নিহত হওয়ার ঘটনায় উপজেলাজুড়ে চলে নানা আলোচনা-সমালোচনা। সবার প্রশ্ন সজীবের হাতে অস্ত্র এলো কীভাবে। তার হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার নেপথ্যেই বা কারা রয়েছেন। এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন এ প্রতিবেদক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সজীব পৌর শহরের নবারুণ সার্ভে অ্যান্ড পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের ৬ষ্ঠ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। সে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে পড়াশোনার খরচ বহন করত। একপর্যায়ে শহরের একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সজীব ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালানোর আড়ালে সন্ত্রাসী বাহিনীর অস্ত্র বহন করত। ঘটনার দিন এমনই একটি অস্ত্রে অসাবধানতাবশত চাপ লেগে গুলি বের হয়। এতেই বিদ্ধ হয়ে মারা যায় সাব্বির।
এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে খবরের শিরোনামে আসে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার। এসব ঘটনায় মামলা হলেও উদ্ধার হয়নি বেশিরভাগ অস্ত্র। চলতি বছরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগা ইউনিয়নে নৌকার উঠান বৈঠক শেষ করে ফেরার পথে হামলার শিকার হন ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি রেজাউল খান। বগা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দুপক্ষের দ্বন্দ্বের জেরে তার ওপর হামলার ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। হামলার সময় আতঙ্ক সৃষ্টি করতে সন্ত্রাসীরা অবৈধ অস্ত্রে শটগানে ফাঁকা বুলেট ছোড়ে বলে অভিযোগ।
এ ঘটনায় বগা ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদ হাসানসহ ১৫ জনকে আসামি করে হত্যাচেষ্টা মামলা করেন রেজাউলের ভাই মামুন খান। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
এর আগে ২০২১ সালে নওমালা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রকাশ্য অস্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়। একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। সেই ঘটনায় ব্যবহার করা অস্ত্রও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ২০১৮ সালে সদর ইউনিয়নে ছাত্রলীগের সভায় হামলার ঘটনা ঘটে। এসময় হামলাকরীরা স্থানীয় সংসদ সদস্য আ.স.ম ফিরোজের ছেলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য রায়হান শাকিবের বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে হত্যার হুমকি দেয়। এ ঘটনায় থানায় মামলাও হয়েছিল। তবে এখন পর্যন্ত সেই অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি।
এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক বিরোধের জের ও স্থানীয় বিভিন্ন নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে অবৈধ অস্ত্রের মহড়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনার বছরের পর বছর পার হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অস্ত্র উদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ সচেতন মহলের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা, নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও রাজনৈতিক নেতাদের সুনজরে থাকতেই ব্যবহার হয় এসব অস্ত্র। সন্ত্রাসীরা সাধারণত দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করে। তবে সম্প্রতি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রও তাদের হাতে রয়েছে। অধিকাংশ সময় অস্ত্র পরিবহনে ব্যবহার করা হয় ‘কিশোর গ্যাং’ সদস্যদের।
সাবেক উপজলো মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শামসুল আলম মিয়া বলেন, ‘সম্প্রতি অস্ত্র উদ্ধার অভিযান কোনোভাবেই সন্তোষজনক বলা যায় না। অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি এবং মাদকের দাপটে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। মানুষ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে।
পটুয়াখালী-২ (বাউফল) আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক চিফ হুইপ আ.স.ম ফিরোজ বলেন, ‘শিক্ষিত জনপদ বাউফলে বিগত বিশ-ত্রিশ বছরে এরকম অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখিনি। কয়েক বছর ধরে অবৈধ অস্ত্রে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। এটা উদ্বেগজনক। অবৈধ অস্ত্র ও মূল হোতাদের ধরতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে। আশা করি তারা দ্রুতই পদক্ষেপ নেবেন।’
জানতে চাইলে বাউফল থানার ওসি শোনিত কুমার গায়েন বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার এবং হত্যার অভিযোগে সজীবের নামে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। দুই মামলায় সজীবকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। তার ব্যবহৃত অস্ত্রটিও উদ্ধার করা হয়েছে। সজীবের হাতে ওই অস্ত্র কোথা থেকে এলো, কারা জড়িতÑ এসব তথ্য উদঘাটনের চেষ্টা করছে পুলিশ।’
বিগত দিনে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি যোগদান করার পর থেকে অস্ত্র উদ্ধার ও জড়িতদের আইনের আওতায় আনার বিষয়ে কাজ শুরু করেছি। তদন্তের স্বার্থে এর বাইরে আর কিছু বলা যাবে না।’