বীরাঙ্গনা জহুরা বেগম
রফিকুল ইসলাম, সারিয়াকান্দি, বগুড়া
প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০২৪ ১১:২৫ এএম
মৃত্যুর আগে বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি পেতে চান জহুরা বেগম
বিজয়ের ৫২ বছরেও বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি পাননি বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার জহুরা বেগম। বয়স হয়েছে, অসুখবিসুখের শেষ নেই। মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অন্য ১০ জন নারীর মতোই চলছিল ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের বাঁশহাটা এলাকার জহুরা-হাবিবুর রহমানের দাম্পত্যজীবন। স্বামী-স্ত্রী মিলে কোনোমতে নুনভাত খেয়ে জীবন যাপন করলেও তার ইজ্জতের বিরুদ্ধে কটুকথা বলার কারও দুঃসাহস ছিল না।
১৯৭১ সালের একদিন পাক হানাদার বাহিনীর লোভলালসার শিকারে সর্বস্বহারা জহুরার সংসারে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। শুরু হয় প্রতিবেশী ও স্বজনদের ঘৃণা। বাবার বাড়িতে চিকিৎসা শেষে স্বামীর সংসারে ফিরে এসে স্বাভাবিক জীবন শুরু করলেও অদ্যাবধি প্রতিবেশীরা বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত করে আসছেন। বিজয়ের ৫২ বছরেও সর্বস্ব হারানোর বেদনা আর স্বীকৃতি না পাওয়ার ক্ষোভে অনবরত কান্নায় দুই চোখের দৃষ্টি প্রায় হারানোর পথে। শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি পেলে মরেও শান্তি পেতেন।
জহুরা বেগম মহান মুক্তিযুদ্ধকালে তার সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনীর ঘটে যাওয়া অমানবিক নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি জানান, সর্বস্ব হারানোর কারণে তখন এলাকায় তাকে নিয়ে উপহাস ও কটূক্তি করা হতো। সেই দুঃখে দুই কন্যাসন্তান নিয়ে দীর্ঘদিন বগুড়া শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেছেন। ২০০৪ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য হালনাগাদ করতে এলেও সে সময় বাসায় না থাকায় অন্য ভাড়াটিয়াদের দেওয়া তথ্যে জাতীয় পরিচয়পত্রে নিজের ছবি ঠিক থাকলেও নাম, পিতা-মাতার নাম, জন্মতারিখ এবং জন্মসাল ভুল লিপিবদ্ধ হয়েছে। উপজেলা নির্বাচন অফিসে সংশোধনের জন্য আবেদন করলেও আজও কোনো সমাধান পাননি।
২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করেন উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নাজনীন নাহার ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডা. মোছা. হাছিনা আখতার। স্থানীয়ভাবে তার বীরাঙ্গনা স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সারিয়াকান্দি উপজেলা কমান্ডের কাছে চিঠি লেখেন ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের তৎকালীন কমান্ড প্রয়াত সোহরাব হোসেনের স্বাক্ষরিত একটি দরখাস্ত উপস্থাপন করেন। তা ছাড়া গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিবগের্র সঙ্গে কথা বলে মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনীর দ্বারা নির্যাতন ও ধর্ষিত হওয়ার সত্যতা পাওয়া যায়।
উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উপস্থাপন করা হলেও অজ্ঞাত কারণে আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
সারিয়াকান্দি উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম মন্টু মণ্ডল বলেন, ‘যখন সরকার বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি দিয়েছে, সুযোগসুবিধার সৃষ্টি করেছে তখন থেকে চেষ্টা করেছে এখন পর্যন্ত হয়নি। আমি ব্যক্তিগতভাবে খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি সে একজন বীরাঙ্গনা। আমি আশা করব সরকারের যতগুলো সংস্থা আছে তাকে বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং স্বীকৃতি দিয়ে সঠিক মূল্যায়ন করবে।’
সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘আমরা জহুরা বেগমের আবেদনটি পেয়েছি। তদন্ত করে তার নারী মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সত্যতা পেয়েছি। আমরা আবার যাচাইবাছাই করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাব; যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে তাকে গেজেটভুক্ত করে নারী মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেওয়া হয়।’