গাইবান্ধা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০২৪ ০০:১৭ এএম
আপডেট : ০৩ এপ্রিল ২০২৪ ১১:০২ এএম
নিহত জোবায়ের রহমান নাজিউল। প্রবা ফটো
জীবন দিয়েও বাঁচাতে পারলেন না আত্মহত্যা করতে যাওয়া গৃহবধূকে। অন্যের জীবন বাঁচাতে যাওয়া এ মানবিক কিশোর জোবায়ের রহমান নাজিউল। বিরল এমন ঘটনা শোক সৃষ্টি করেছে জেলাজুড়ে। সেই সঙ্গে মানবিকতা যে চিরন্তন সত্য, তা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। জোবায়েরের এমন আত্মত্যাগে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবসহ এলাকাবাসী শোকে কাতর হয়ে পড়েছে।
গত সোমবার গাইবান্ধা শহরের মাঝিপাড়ায় অপরিচিত এক নারীকে বাঁচাতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় জোবায়ের নিহত হন। ওই নারী শিশুসন্তান কোলে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। জোবায়ের তাকে বাঁচাতে গেলে তিনজনই ট্রেনের ধাক্কা খান। এতে শিশুসন্তান বেঁচে গেলেও ওই নারী ও জোবায়েরের মৃত্যু হয়। জোবায়ের গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার ভরতখালী গ্রামের বাসিন্দা জাহিদুল ইসলামের ছেলে।
ভরতখালী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামজুড়ে নীরব নিস্তব্ধতা। সবাই জোবায়েরের বাবা-মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। পাড়াপড়শিসহ সবার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। জোবায়েরের মা অচেনা মানুষ দেখেই আহাজারি করে বলছেন, ‘আমার কলিজার টুকরো ধনকে এনে দেও। আমার ধনকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতাম। জীবনের একমাত্র ভরসা ছিল আমার ছেলে। ভালো করে লেখাপড়া করবে, সেজন্য শহরে ভালো স্কুলে ভর্তি করালাম। মাসে মাসে এখন আমি কার কাছে টাকা পাঠাব। এখন আমি কাকে নিয়ে বেঁচে থাকব।’
এদিকে নিজের জীবন দিয়ে নিষ্পাপ শিশুকে বাঁচানোয় বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে জোবায়েরকে ‘মানবিক কিশোর’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন অনেকে। জিয়াম নামে জোবায়েরের এক সহপাঠী বলেন, ‘জোবায়ের নিজের জীবন দিয়ে যে কাজটি করেছে তা ভোলবার মতো না। অন্যের জীবন বাঁচাতে গিয়ে তার স্বপ্ন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিল। কোনো রক্তের সম্পর্ক নয়, শুধু তরতাজা জীবন দুটোকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন দিতে হলো।’
গত সোমবার দুপুরে পারিবারিক কলহের জেরে গৃহবধূ রাজিয়া বেগম শিশুসন্তানসহ ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তখন রেললাইনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন জোবায়ের। তিনি তাদের ঝাঁপ দিতে দেখে রেললাইন থেকে ধাক্কা দেন। এ সময় সান্তাহারগামী লোকাল ট্রেনের ধাক্কায় তিনজনই রেললাইন থেকে ছিটকে পড়েন। এতে গৃহবধূ রাজিয়া ও জোবায়ের মারা যান। রাজিয়া গাইবান্ধা শহরের মাঝিপাড়ার দিনমজুর আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী।
তবে আহত দেড় বছরের শিশু আবির হোসেন বর্তমানে শঙ্কামুক্ত। পরিবারের লোকজন তার দেখভাল করছেন।
স্থানীয়রা জানান, রাজিয়ার বাড়ি সুনামগঞ্জে। চার বছর আগে মুঠোফোনে প্রেমের সম্পর্কের পর আনোয়ারের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে শহরের মাঝিপাড়ায় বসবাস করতেন। আনোয়ার মাদকাসক্ত ও বেকার। সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকত। শিশুসন্তানের ঠিকমতো খাবার দিতে পারত না। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত। দিনের পর দিন স্বামীকে উপার্জনের জন্য বললেও কাজ হচ্ছিল না। ক্রমেই তাদের মধ্যে ক্ষুব্ধতা সৃষ্টি হয়। ঘটনার আগের রাতে একই বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে কলহ হয়। এর জেরে রাজিয়া শিশুকে কোলে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিতে যান।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রতিনিয়ত শিশুসন্তানের গায়ে হাত তুলত রাজিয়া। এ নিয়ে ঘটনার আগের রাতে তাকে গালিগালাজ করি। এরপর রাতেই ঘর থেকে বের হয়ে ছেলেসহ অন্য রুমে ঘুমায়। সকালে কাজে চলে যাই। পরে ১১টার দিকে শুনতে পাই আমার স্ত্রী ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মারা গেছে।’