শিশির খাঁন, সদরপুর-চরভদ্রাসন (ফরিদপুর)
প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৪ ১৫:৩৩ পিএম
আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২৪ ১৫:৪০ পিএম
ভয়ংকর চায়না দুয়ারি জাল। প্রবা ফটো
ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার বিভিন্ন খাল, বিল ও নদীতে ভয়ংকর চায়না দুয়ারি জাল ছড়িয়ে পড়েছে। হালকা ও মিহি বুননের ছোট ফাঁসের এই জালে আটকা পড়ে মারা পড়ছে নানা প্রজাতির ছোটবড় মাছ ও পোনা। কম পরিশ্রমে বেশি মাছ পাওয়ায় কারেন্ট জালের চেয়েও বিপজ্জনক এই জাল জেলেদের কাছে জনপ্রিয়।
চায়না দুয়ারিকে স্থানীয়ভাবে জাল বলা হলেও এটি আসলে মাছ ধরার বিশেষ একটি ফাঁদ। একে চায়না জাল, ম্যাজিক জাল ও ঢলুক জালও বলা হয়। এ ফাঁদের কারণে জলাশয়গুলো দিন দিন মাছশূন্য হয়ে পড়ছে। মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা চাঁই বা কারেন্ট জালের চেয়েও ভয়ংকর ফাঁদ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গোল লম্বাকৃতির চায়না দুয়ারি জালের দৈর্ঘ্য মানভেদে ৫০ থেকে ১০০ ফুট। প্রস্থে এক থেকে দেড় ফুট। লোহার চারকোনা বা গোলাকার রড দিয়ে অনেক ফ্রেম বসিয়ে এই জাল তৈরি করা হয়। এটি নদী-খাল বা জলাশয়ের একেবারে তলদেশের মাটির সঙ্গে মিশে থাকে। এ ছাড়া জালের গিঁট বা ফাঁস এতই ক্ষুদ্র যে পানি ছাড়া কিছু বের হতে পারে না। ফলে উজান-ভাটি সব দিক থেকে মাছ ভেতরে ঢুকে আর বের হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই জালে অসংখ্য মাছ, মাছের পোনাসহ সব ধরনের জলজ প্রাণী-উদ্ভিদ, খাদ্যকণা ধ্বংস হচ্ছে। মাছের বংশবিস্তার হুমকির মুখে পড়ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলা মৎস্য দপ্তর থেকে এক-দুই কিলোমিটারের মধ্যেই লোহারটেক কোল ও পদ্মা নদীর বিভিন্ন স্থানে চায়না দুয়ারি দিয়ে মাছ ধরছে মৎস্য শিকারিরা। তারা এই ফাঁদ দিয়ে মাছ শিকার করলেও বর্ষা মৌসুমে তাদের মহোৎসব নামে। জোয়ারের পানির সঙ্গে ডিমওয়ালা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ খাল-বিলসহ বিভিন্ন জলাশয়ে বংশবিস্তারের জন্য আসার গতিপথেই পাতা হচ্ছে এই ফাঁদ। মাছ ধরার পর পদ্মা নদীর পাড়ে চায়না দুয়ারি রোদে শুকাতেও দেখা গেছে। উপজেলার সর্বত্রই এ জাল ব্যবহার করে মাছ নিধন হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জেলে বলেন, প্রথম দিকে এই জাল চীন থেকে আমদানি করা হতো বলে দামও ছিল চড়া। একেকটি জাল কিনতে প্রায় ছয়-সাত হাজার টাকা খরচ হতো। বর্তমানে একই আদলে দেশের বিভিন্ন কারখানায় তৈরি হচ্ছে এই জাল। দাম আগের তুলনায় অর্ধেক হওয়ায় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এই জাল দিয়েই মাছ ধরছে। সবাই এই ফাঁদে মাছ ধরায় অন্যান্য জালে আর মাছ ধরা পড়ে না। তাই বাধ্য হয়ে আমরাও এই জাল দিয়েই মাছ ধরছি।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. কাউছার বলেন, ‘পোনা মাছ বাজারে দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। এই নিষিদ্ধ ফাঁদ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝেই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। এরপরও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী লুকিয়ে মাছের বংশ ধ্বংস করার এই জাল চড়া মূল্যে বিক্রি করছে।’
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে মাছ ধরার জালের ফাঁসের অনুমোদিত পরিমাপ সাড়ে পাঁচ সেন্টিমিটার। জালের ‘ফাঁস’ বা ঘনত্ব এর চেয়ে কম হলে তা আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ। যদিও নিষিদ্ধ জালের তালিকায় চায়না দুয়ারির নাম উল্লেখ নেই। তবে জালের ফাঁসের ঘনত্ব বিবেচনায় বিদ্যমান আইন অনুযায়ী এটি নিষিদ্ধ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নিষিদ্ধ জালে মাছ নিধন বন্ধে কোনো অভিযান চোখে পড়ে না। তাই অসাধু মাছ শিকারিরা কার্যত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা যত্রতত্র এ জাল দিয়ে অবাধেই মাছ নিধন করছে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘লোকবল সংকটের কারণে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। মৎস্য সম্পদ রক্ষায় দ্রুত এই চায়না দুয়ারি বিনষ্টে অভিযান চালানো হবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফয়সাল বিন করিম বলেন, ‘সদ্য এখানে যোগদান করেছি। এ ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উঠান বৈঠক করে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সতর্ক করা হবে। পাশাপাশি মৎস্য সম্পদ রক্ষায় আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’