রাজু আহমেদ, রাজশাহী ও শাহিনুর সুজন, চারঘাট
প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৪ ১৪:৩৭ পিএম
আপডেট : ২৯ মার্চ ২০২৪ ১৪:৪৮ পিএম
চারঘাটে আর এস কালার ফিশ খামারে বিভিন্ন রঙের মাছ চাষ করছেন দুই ভাই রহমত ও সুজন। সম্প্রতি তোলা। প্রবা ফটো
স্বচ্ছ কাচের অ্যাকুরিয়ামে রঙিন মাছ পালন- একটা সময় ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। তবে সময়ের ব্যবধানে এই শৌখিনতার বিস্তার ঘটেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে ব্যবসার পরিধি। আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে এই শৌখিন মাছ এখন দেশের খামারেই উৎপাদিত হচ্ছে।
একটা সময় দেশের শৌখিন মাছের চাহিদা মেটাতে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হতো। তবে এখন রাজশাহী জেলাতেই বাণিজ্যিকভাবে শৌখিন জাতের রঙিন মাছ উৎপাদন করা হচ্ছে। রঙিন এই মাছকে বলা হয় ‘অরনামেন্টাল ফিশ’ বা ‘অ্যাকুরিয়াম ফিশ’। এ-জাতীয় মাছের ক্ষেত্রে মা মাছকে বলা হয় ‘ব্রুট’ আর পোনাকে বলা হয় ‘ফ্রাই’।
রঙিন মাছ আমদানিতে ভ্যাট বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। এতে দেশে উৎপাদিত এই মাছের চাহিদা বেড়েছে কয়েক গুণ। তবে মোট চাহিদার মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ জোগান দিতে পারছে দেশের খামারগুলো। করোনাকালে ঘরবন্দি মানুষের মাঝে অ্যাকুরিয়াম ফিশ পরিচর্যায় আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। ফলে গত ৪ বছর ধরে স্থানীয় বাজারে এই ব্যবসাটার প্রসার ঘটতে শুরু করে।
দিনে দিনে বাড়ছে উদ্যোক্তা খামারির সংখ্যা। খামারিরা মৌসুমে একেক প্রজাতির মাছ থেকে আয় করছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। রাজশাহী নগরীর নিউমার্কেটসহ কয়েকটি স্থানে এই রঙিন জাতের মাছ বিক্রি হয়। যেখানে প্রতি মাসে বিক্রি হচ্ছে গড়ে ২০ লাখ টাকার অরনামেন্টাল ফিশ।
জেলার অরনামেন্টল ফিশ ব্যবসায়ীদের মধ্যে রেজওয়ানুল হক হেলাল অন্যতম। পবা উপজেলায় পৈতৃক দুই বিঘা জমির মধ্যে প্রায় এক বিঘা জমিতে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘জলপরী খামার বাড়ি’। ৭ বছর আগে শখের বশে শুরু হয় তার অরনামেন্টাল ফিশ পরিচর্যা। তবে এখন তিনি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করছেন। খামারে ১ টাকার পোনা থেকে শুরু করে ৭ হাজার টাকার বড় আকৃতির অরনামেন্টাল ফিশ রয়েছে। তিনি প্রতি মাসে গড়ে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকার অরনামেন্টাল ফিশের ব্রুট ও ফ্রাই বিক্রি করে থাকেন। ক্রেতাদের অধিকাংশই ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লাসহ আশপাশের জেলার ব্যবসায়ী।
হেলাল বলেন, এবার শীতে রোগের কারণে অনেক খামারে মাছ মারা গেছে। অনেকে খামার বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা মৎস্য বিভাগ থেকে চিকিৎসা সহযোগিতা ও খামারিদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য আহ্বান জানাতে চাই।
হেলালের মতো বাণিজ্যিকভাবে অরনামেন্টাল ফিশ চাষে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার পরাপনপুর গ্রামের দুই ভাই রহমত আলী ও খালেদ মাহমুদ সুজন। তারা গড়ে তুলেছেন আরএস কালার ফিশ ফার্ম। নিজস্ব খামারে করছেন প্রায় লক্ষাধিক রঙিন মাছের বাণিজ্যিক চাষ, বিক্রয় করছেন রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় জেলা শহরে। স্বপ্ন দেখছেন একদিন বিদেশেও রপ্তানি করবেন এই মাছ। উৎপাদন বৃদ্ধি ও কারিগরি সহায়তায় এগিয়ে এসেছে উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর। সরাসরি থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর থেকে মাছের পোনা সংগ্রহ করে রেণু উৎপাদনের মাধ্যমে মাছ উৎপাদন করছেন তারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, ছোট-বড় ২০ জাতের প্রায় লক্ষাধিক বিদেশি রঙিন মাছ রয়েছে তাদের খামারে। কথা হয় বড় ভাই রহমতের সঙ্গে। তিনি বলেন, শখের বশে ২০১৭ সালে ছোট ভাই সুজনকে নিয়ে শুরু করি রঙিন মাছের চাষ। প্রথম দিকে বাড়ির আঙিনায় ৪টি স্যানেটারি রিং দিয়ে এই মাছ চাষ করতাম। চাহিদা থাকায় বছর ঘুরতেই লাভের মুখ দেখি। ফলে প্রাইভেট চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ শুরু করি।
সুজন বলেন, ঢাকার কাঁটাবন ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দেশের প্রায় সকল জেলা ও উপজেলায় আরএস কালার ফিশ ফার্মের রঙিন মাছ বিক্রয় করা হয়। রঙিন মাছ বিক্রির মাধ্যমে মাসে প্রায় লক্ষাধিক টাকা আয় করেন বলে জানান।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, একটা সময় রঙিন মাছ শৌখিনতার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে এখন দেশের বাজারে শৌখিন রঙিন জাতের মাছের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকেই উৎপাদক ও উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আসছেন। রাজশাহীতে এমন একাধিক দৃষ্টান্ত রয়েছে। এটাকে সম্প্রসারণের কথা ভাবছি। উদ্যোক্তারা চাইলে আমরা তাদের কারিগরি সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।