× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সাইনবোর্ডে ঝি-পুতের বাপের নাম নাই

ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার

প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০২৪ ১০:০৬ এএম

আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৪ ১১:০৯ এএম

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলী আকবরের স্ত্রী লালমতি বেগম। প্রবা ফটো

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলী আকবরের স্ত্রী লালমতি বেগম। প্রবা ফটো

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভুনবীর ইউনিয়নের ছায়াঘেরা নিভৃত গ্রাম লইয়ারকুল। পুরো জেলায় গ্রামটি শহীদদের গ্রাম হিসেবে পরিচিত। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জেলার বিভিন্ন স্থানে দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে যে ৯৮ জন প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, তাদের মধ্যে লইয়ারকুল গ্রামেরই ছিলেন ৬ জন। তারা ছিলেন আবার পরস্পর আত্মীয়। তাদের মধ্যে অন্যতম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলী আকবর।

কৃষক আব্দুল ছোবহানের ছেলে আলী আকবর মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ছোট ছোট চার ছেলে ও এক মেয়েকে বাড়িতে রেখে ভারতে চলে যান গেরিলা ট্রেনিং নিতে। সেখান থেকে ফিরে এসে দেশের অভ্যন্তরে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। তার স্ত্রী লালমতি বেগম পাঁচ সন্তানকে নিয়ে বাড়িতে রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের সংস্থানে নিয়োজিত ছিলেন। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় রাজাকাররা পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে আলী আকবরের গতিবিধির খবর জানিয়ে দেয়। একদিন দুপুরে কমলগঞ্জ উপজেলার কালেঙ্গা থেকে আলী আকবরকে ধরে শ্রীমঙ্গলে হানাদারদের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সহযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য জানতে তার ওপর চালানো হয় বর্বর নির্যাতন। নির্যাতনের মুখেও পাকিস্তানি বাহিনীকে কোনো তথ্য দেননি তিনি। পরে শ্রীমঙ্গল শহরের সাধুবাবার গাছতলাসংলগ্ন ছড়ার পাশে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হায়েনারা। এখানেই শেষ ঠিকানা হয় তার।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলী আকবরের স্ত্রী লালমতি বেগম এখন শতবর্ষের কাছাকাছি। ষাটোর্ধ তিন ছেলে মো. আব্দুল গফুর, মো. আব্দুর রহিম, মো. আব্দুর রব, মো. আব্দুল হাই ও মেয়ে পেয়ারা বেগম। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও শহীদ আলী আকবরের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন তারা। 

সম্প্রতি লালমতি বেগম প্রতিদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় আমার ঝি-পুতের (মেয়ে-ছেলের) বাপসহ (বাবাসহ) ৬ জন মানুষ মরছে পাঞ্জাবির মেল (হানাদারদের দ্বারা হত্যার শিকার)। আইজ (আজ) আমার নাম নাই, কিচ্ছু নাই। আইজ আমি বিছনার মাঝে। উঠতাম (উঠতে) পারি না, বইতাম (বসতে) পারি না, খাইতাম (খেতে) পারি না, আমার-ই দশা। অখন (এখন) আমি কিতা (কী) করতাম? আল্লায় না নিলে তো আমি যাইতামও পারি না। আমার সব শেষ করি লাইছি। আমার পুত (ছেলে) আছে চারটা। থাকলে কিতা (কী) হইব এটাইন (এগুলো) আওরা (বোকা)। এরা চালাক নায়। বড়লোকরা আমার সব মারি-মারি (মেরে) খাইলাছে (খেয়ে ফেলেছে)। আমার এই বেমারের (অসুস্থতা) সময় আমি বহুত কষ্টে আছি। আমার পুতেরা (ছেলেরা) যা তৌফিকে কুলায় তা আইন্না আমারে খাবায় (খাওয়ায়)। এখন আমি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বউ (স্ত্রী) হিসাবে ভাতা পাই। এই দিয়া আমার বড়ি (ঔষধ) চলে আর সংসারে তুরা (সামান্য) খরচ হয়। এখনো কষ্ট শেষ অইছে না।’ 

যুদ্ধকালের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লালমতি বেগম বলেন, ‘আমার ইতিআস (ইতিহাস), কী কষ্ট কইরা আইছি। জঙ্গল-বঙ্গল কত জায়গা ঘুইরা হাফে (সাপ), জোঁকের কামড় খাইয়া আইজ আইয়া বিছনাত (বিছানায়) পড়ছি। আমারে কেউ খবর লয় (নেয়) না। যুদ্ধের সময় কত মুক্তিযোদ্ধারে রাইন্দা খাবাইছি (রান্না করে খাওয়াইছি), কততা (কত কিছু) করছি। ওই সময় আমার ছোট-ছোট বাচ্চাইনরে (শিশু সন্তানদের) লইয়া (নিয়ে) আমি বনে-বনে ঘুরছি। পাঞ্জাবিরা আমার ঘর-দুয়ার (ঘর-বাড়ি) আগুন দিয়া জ্বালাইলাইছিল (জ্বালিয়ে দিয়েছিল) ষোলো আনা (পুরোটা)। আমি কুলির (শ্রমিকের) বাড়িত গিয়া রইছি ছোট ছোট বাচ্চাইন (শিশু সন্তানদের) লইয়া (নিয়ে)। বাচ্চাইন বাচানির (সন্তানদের বাঁচানো) লাগি বহুত (অনেক) কষ্ট করছি। আমার ঝি-পুতে বহুত কষ্ট পাইছে সেই কালে (যুদ্ধের সময়)।’ 

সংসার জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ঝি-পুতের বাপ যখন যুদ্ধে গেছিলেন, তখন আমার তারা ছোট ছোট আছিল। যুদ্ধের আগে কত সুন্দর আছিল আমরার সংসার। তাইন (তিনি) বাচ্চাইনরে কোলে কইরা বাজারে-স্কুলে লইয়া যাইতেন (নিয়ে যেতেন)। তাইন থাকতে আমরা বাচ্চাইনরা কোনো কাম-কাজ (কাজ-কর্ম) করছে না।’ 

মুক্তিযুদ্ধে স্বামী আলী আকবর শহীদ হওয়ার স্মৃতি হাতড়ে লালমতি বেগম বলেন, ‘শেষ দিকে বাচ্চাইনরার বাপরে গুল্লি (গুলি) কইরা (করে) পাঞ্জাবিরা (হানাদার বাহিনী) মারার পর আমরা বহুত কষ্ট করছি। আমরা তাইনের (তাঁর) লাশটাও (মরদেহ) পাইনি। এখনও তানরে (স্বামী) ভুলতে পারি না। সবসময় মনে অয় (হয়)। হুনছি (শুনেছি) যে জাগাত (যে স্থানে) পাঞ্জাবিরা তানরে (স্বামী) গুল্লি কইরা মারছিল সেই জাগাত (স্থানে) সাইনবোর্ডে বহুত জনের (অনেকের) নাম আছে। আমার ঝি-পুতের বাপের নাম নাই। বহুত দুঃখ লাগে। হকলের (সবার) নাম লিখা অইলে তান নাম লিখা অইল না কিতার লাগি (কেন)?’   

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা