× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বান্দরবান

শুকিয়ে গেছে ঝিরি-ঝরনা, পানির সংকটে পাহাড়িরা

সুফল চাকমা, বান্দরবান

প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৪ ১১:৫৫ এএম

আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৪ ১২:০১ পিএম

বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নের সুয়ালক খালের পাশে কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করছে আমতলী পাড়ার লোকজন। বুধবার তোলা। প্রবা ফটো

বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নের সুয়ালক খালের পাশে কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করছে আমতলী পাড়ার লোকজন। বুধবার তোলা। প্রবা ফটো

বান্দরবান জেলায় সব ঝিরি-ঝরনা শুকিয়ে গেছে। পুরো জেলায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। বান্দরবানের চিম্বুক-নীলগিরি-থানচি সড়কের দুই পাশে ১১০টি ম্রো পাড়াসহ লামা, আলিকদম, রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি উপজেলার দুর্গম এলাকার পাহাড়ি পল্লীগুলোতে বিশুদ্ধ পানির সংকট আরও বেশি। 

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, বান্দরবানের বিভিন্ন উপজেলার পাড়া-বসতি নিকটবর্তী পানির উৎসগুলো শুকিয়ে গেছে। কোথাও চলতে চলতে ঝিরির শেষ মাথায় গর্তে অল্প পানি জমা আছে, সেখান থেকেই বিভিন্ন পাড়ার ম্রো নারীরা পানি সংগ্রহ করছেন। এর মধ্যে অনেক জায়গায় পাথর উত্তোলন করে পানির উৎস ধ্বংস করা হয়েছে। আর যেসব ছোট ছোট খালে অল্প পানি আছে, সেখানে হাতি দিয়ে গাছ টানার কারণে হাতির মলমূত্রে খালের পানি দূষিত হয়ে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ক্রামাদি পাড়া, দেওয়াই হেডম্যান পাড়া, যামিনী পাড়া, ম্রোলং পাড়া, বসন্ত পাড়া, নোয়া পাড়াসহ কমপক্ষে ১১০টি পাড়ায় পানির সংকট সবচেয়ে বেশি। 

ম্রোলং পাড়ার বাসিন্দা বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজের নার্সিংয়ের ছাত্রী চামলে ম্রো বলেন, কাকড়া ঝিরি থেকে পানি আনতে আসা-যাওয়ায় দেড় ঘণ্টা লাগে। ভোর ৪টায় পানি আনতে গিয়ে সকাল ৬টার সময় পাড়ায় ফিরে আসা যায়। দুই-এক মগ পানি নেওয়ার পর ৮-১০ মিনিট পানির জন্য অপেক্ষা করতে হয়। বয়স্ক নারীরা রাত ২-৩টার সময় পানি আনতে যান। একসঙ্গে সবাই গেলে পানি পাওয়া যায় না, তাই প্রতিবার দুজন করে পানি আনতে যেতে হয়। এই ঝিরির পানি শুকিয়ে গেলে আরও দূরে একটি ঝিরি আছে, সেখানে কাঁকড়ার গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়। 

ম্রোলং পাড়ার বাসিন্দা ৬১ বছরের নারী হাই প্লেম ম্রো বলেন, শুষ্ক মৌসুমের সময় পাড়ার নারীদের অন্যান্য কাজ বাদ দিয়ে শুধু নিরাপদ পানি সংগ্রহ করতেই অধিকাংশ সময় ব্যয় করতে হয়। বর্তমানে ২৬টি পরিবারের ম্রোলং পাড়ায় প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত পানির তীব্র সংকট থাকে। পাড়ার নারীদের পরিবারের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পানির জন্য খুব কষ্ট করতে হয়। 

লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার লাংগি পাড়ার মেনচং ম্রো বলেন, শুষ্ক মৌসুম এলে পাড়ার মানুষদের পানির কষ্টের সীমা থাকে না। ছোট ছোট ঝিরিগুলোর পানি শুকিয়ে যায়, আর ছোট খালগুলোতে পানি থাকলেও হাতির মলমূত্রে দূষিত হয়ে যায়। পালং খালের সঙ্গে সংযুক্ত শীল ঝিরি, লেমু ঝিরিসহ ছোট-বড় ছয়টি ঝিরি রয়েছে। এসব ঝিরির পানি দিয়েই আশপাশের ১৩টি পাড়ার লোকজন বেঁচে আছে। অথচ হাতি দিয়ে গাছ টানার কারণে হাতির মলমূত্র ঝিরির পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এ পানি ব্যবহার করায় গত সপ্তাহে পাড়ার কয়েকজন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল। ঝিরিতে গোসল করলেও শরীর চুলকায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে পাড়ায় পানিবাহিত রোগ মহামারি আকার ধারণ করবে।

রেনিক্ষ্যং বাগান পাড়ার ৩৮ ম্রো পরিবারের একমাত্র পানির উৎস বিউসনা ঝিরি। ঝিরিতে তহ্জিংডং এনজিও থেকে জিএফএস পাড়ায় পানি সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে ঝিরির পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে পাড়ায় তীব্র পানিসংকট থাকে বলে জানান কনইয়াং ম্রো নামের এক বাসিন্দা। 

ক্রামাদি পাড়ায় ৪৪ পরিবারের ম্লাওঅ ঝিরি ও কাওতেওঅ ঝিরি দুটির ওপর নির্ভরশীল। সিওঅ ঝিরিতে জিএফএস পদ্ধতিতে ৮ হাজার ফুট পাইপ দিয়ে পানি পাওয়ার জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। 

ক্রামাদি পাড়ার রাংকোইসা ম্রো (৭১) বলেন, পানির অভাবে দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত নিয়মিত গোসল করা যায় না। অনেক দূরে যেতে হয়। যারা কাজে যায়, যে যেখানে পানি পায় সেখানে গোসল করে বাড়িতে ফেরে। আর নারীরা জুমের কাজে যাওয়ার সময় ময়লা কাপড় থাকলে সঙ্গে করে নিয়ে যায়, যেখানে সামান্য পানি পায় সেখানেই কাপড় ধুয়ে আনে। এভাবে চলে শুষ্ক মৌসুমে ম্রো পাড়াবাসীর জীবন। এই অবস্থা চলতে থাকলে পানির সংকটের কারণে এখান থেকে অন্যত্র চলে যেতে হবে। 

একই পাড়ার পাকু ম্রো বলেন, ইটভাটায় কাঠ নেওয়া এবং অবৈধ কাঠ ব্যবসায়ীদের কারণে বনাঞ্চল উজাড় করা হয়েছে। ঝিরি-ঝরনাগুলো থেকে অবাধে পাথর উত্তোলন করার কারণে এবং আবহাওয়া পরিবর্তন হওয়াতে সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় পানির সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। 

ক্রামাদি পাড়ার তুমপিয় ম্রো বলেন, কেউ একবার পানি আনার পর তিন ঘণ্টা পরে আরেকজন পানি পায়। সেজন্য ঝিরির কুয়াতে আসার আগে পাড়াতে জিজ্ঞাসা করতে হয়Ñ কুয়াতে কেউ গেছে কি না, কিংবা কে কখন পানি আনতে গিয়েছিল। জিজ্ঞাসা না করে ঝিরিতে গেলে দুই থেকে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ২০ লিটারের মতো পানি পাওয়া যায়। 

সুয়ালক ইউনিয়নের আমতলী মারমা পাড়ার কারবারি মং প্রু সাইন মারমা বলেন, পাড়ায় তাদের ১৫০টি পরিবার, তঞ্চঙ্গ্যা আমতলী পাড়া, মাঝের পাড়া, হেডম্যান পাড়াসহ ৫০০ পরিবার শুষ্ক মৌসুমে সুয়ালক খালের ওপর নির্ভরশীল। কোনো রকম গোসল করা যায়, সমস্যা বাধে খাওয়ার পানি নিয়ে, সুয়ালক খালের পাড়ে পাত কুয়া তৈরি করে সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করে পানি পান করতে হয়। দ্বিতীয় আর কোনো উপায় নেই, তাই শিশু, যুব, বয়স্কদের দৈনিক ৪-৫ বার পাত কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করে।

ম্রো জনগোষ্ঠীর বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক ইয়াং ঙান ম্রো বলেন, বনাঞ্চল ধ্বংস এবং ঝিরির পাথর উত্তোলন করে পানির উৎস ধ্বংস করার কারণে প্রতি বছর চিম্বুক এলাকার প্রায় ১১০টি পাড়ার ম্রো সম্প্রদায় বিশুদ্ধ পানির সংকটে থাকে। দুর্গম এলাকার অন্য সব সম্প্রদায়ের লোকজনও পানির সংকটে থাকে। সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকার কারণে প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত চিম্বুক এলাকাসহ দুর্গম আদিবাসী পাড়াগুলো বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে থাকে। তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এভাবে চলতে থাকলে আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে শুধু পানির অভাবে ম্রো জনগোষ্ঠী চিম্বুক-নীলগিরি এলাকা থেকে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হবে। 

বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপ কুমার দে বলেন, পাহাড়ে অপরিকল্পিতভাবে ঝিরির পাশে তথা পানির উৎসের পাশে গাছ কেটে ফেলার কারণে ঝিরি ও ঝরনার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে পানির লেয়ার ও মাটির অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় পাহাড়ে দ্রুত পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া পাহাড়ের মাটির গর্ভে পাথর থাকায় গভীর নলকূপ বসানোর সুযোগ নেই। সেখানে রিংওয়েল এবং যেসব ঝিরিতে শুষ্ক মৌসুমেও পানি থাকে, বরাদ্দ সাপেক্ষে জিএফএস পদ্ধতিতে পানি সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। চিম্বুক এলাকায় ম্রোসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ পানির কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে জানান তিনি। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা