রংপুর অফিস
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৪ ০৯:৩৫ এএম
আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৪ ১০:৩৬ এএম
তিস্তার চরাঞ্চলে কৃষিজমি রক্ষার দাবিতে সম্প্রতি বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানির বিরুদ্ধে কৃষকদের মানববন্ধন। প্রবা ফটো
ভূমিদস্যু বসুন্ধরা গ্রুপের নজর পড়েছে এবার রংপুরের গঙ্গাচড়ায় তিস্তা নদীর বুকে জেগে ওঠা চরের ওপর। সেখানে ‘বসুন্ধরা অয়েল এন্ড গ্যাস কোম্পানী লিমিটেড’ নামে কারখানা খোলার কথা বলে ৯০০ একর জমি দখলের পাঁয়তারা চালাচ্ছে এই ভূমিদস্যু গ্রুপ। এ নিয়ে ফুঁসে উঠেছে ওই এলাকার সর্বস্তরের মানুষ। বসুন্ধরার সন্ত্রাসী বাহিনী ও কৃষকরা বর্তমানে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। যেকোনো সময় এলাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কৃষকদের অভিযোগ গত ৭০ বছর ধরে চরের খাসজমিতে নানা ফসল ফলিয়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। কিন্তু এবার কৃষকদের সেখানে আবাদ করতে দেয়নি ভূমিদস্যু বসুন্ধরার সন্ত্রাসী বাহিনী। এতে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। নদীভাঙনের শিকার, সর্বস্ব হারা এসব কৃষক জীবিকার পথ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তারা ভূমিদস্যু বসুন্ধরার বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে অবিলম্বে কোম্পানীর নামে জমি দখলের উৎসব বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। অন্যদিকে উত্তরের ‘জীবনরেখা’ তিস্তা দখল করে বসুন্ধরা কারখানা স্থাপন করার চেষ্টা করলে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার হুমকি দিয়েছেন নদীরক্ষা আন্দোলনের সংগঠকরা।
যেভাবে চরের জমি দখল করছে ভূমিদস্যু বসুন্ধরা
জানা গেছে, গত বছর বসুন্ধরা গ্রুপের কর্মকর্তারা রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার চর ছালাপাক ও আলালের চর এলাকা পরিদর্শন করেন। ওই এলাকাকে ‘অনুন্নত’ উল্লেখ করে সেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘বসুন্ধরা অয়েল এন্ড গ্যাস কোম্পানী লিমিটেড’ নামে একটি শিল্প-কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেয় তারা। এ লক্ষ্যে প্রকল্প ব্যবস্থাপক শাহীনুর আলম গত ২০ নভেম্বর রংপুর জেলা প্রশাসক বরাবর একটি চিঠি দেন। সেখানে বেকারত্ব দূরীকরণের উদ্দেশ্যে গঙ্গাচড়া উপজেলার ছালাপাক ও আলাল মৌজায় শিল্প-প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য কোম্পানীর নামে খাসজমি প্রতীকী মূল্যে দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্তের আবেদন করা হয়। এরপর বসুন্ধরার কর্মকর্তারা চর ছালাপাক ও আলালের চরে নদীভাঙনের শিকার ভিটেমাটিহারা ব্যক্তিদের টার্গেট করে। প্রথমে তিস্তা নদীতে বিলীন হওয়া প্রায় ৪০ একর জমি তাদের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে কিনে নেয় ভূমিদস্যু বসুন্ধরা। পরে নদীর পানি শুকিয়ে গেলে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে হাত করে ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে ছালাপাকারে মধ্যচরে একটি টিনের ঘর তোলা হয়। স্থানীয় কৃষকরা প্রতি বছরের মতো এবারও চরের জমিতে আলু, ভুট্টা, গম, বাদাম, মিষ্টি কুমড়ার আবাদ করতে গেলে তাদের ওপর চড়াও হয় বসুন্ধরার সন্ত্রাসী বাহিনী। অনেক কৃষক মারধরের শিকার হন। সন্ত্রাসীদের হুমকির কারণে এবার চরে ফসল উৎপাদন করতে পারেননি কৃষকরা। এ নিয়ে যারাই বসুন্ধরার বিপক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন, তাদের ওপরই চড়াও হচ্ছে সন্ত্রাসী বাহিনী।
ভুক্তভোগী কৃষক জয়দেবপুর পূর্বপাড়ার বাসিন্দা মকসুদার রহমান বলেন, ‘তিস্তা নদীত হামার সউগ কিছু ভাঙ্গি গেইচে। চরের জমিত আলু, কুমড়া, অসুন, পিঁয়াজ আবাদ করি সারা বছর চলি। এইবার বসুন্ধরা খাসজমি জোর করে দখলের চেষ্টা করতোছে। শেখ হাসিনার কাছে হামার আবেদন যেন হামরা এই সব জমিত আবাদ করি চইলবার পারি।’
স্থানীয় বাসিন্দা ৭৫ বছর বয়সি আব্দুর রহিম বলেন, ‘বাপ-দাদারা এই নদীর চরোত আবাদ করি খাইছে। হামরা নাতি-পুতির ঘরোও আবাদ করি চলতোছি। অ্যাল্যা বসুন্ধরা সেই চরের বালু জমিত নাকি কোম্পানী করবে। জান দেমো, তবু বসুন্ধরাক জমি দেমো না। কারণ এইটা ছাড়া হামার কোনো সম্পদ নাই, চলার মতো পথ নাই।’
সুফলা জমি ‘অনাবাদি’ দেখানোর চেষ্টা
চর ছালাপাক, আলালের চরে তিস্তা নদীর পাড়ে এখন পর্যন্ত কৃষকদের দখলে থাকা খাসজমিতে এবারও মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, সরিষা, গম, বাদাম, ভুট্টাসহ নানা ফসলের আবাদ হয়েছে। গত বছর এই চরের পুরোটায় উৎপাদিত মিষ্টি কুমড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে রপ্তানি করে প্রায় ২০ কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছেন স্থানীয় রপ্তানিকারকরা। এছাড়া এখানকার উৎপাদিত ফসল রংপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। কিন্তু বসুন্ধরার সন্ত্রাসী বাহিনী চর ছালাপাকের মধ্যচরের জমি দখল করে নেওয়ায় সেখানে এবার কৃষকরা আবাদ করতে পারেননি। তাই অন্যান্য বছরে এই সময়ে সবুজ হয়ে থাকা বালুচর এবার বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। নদীভাঙনের শিকার হয়ে বাঁধে আশ্রিত কৃষকরা প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমের ৬ মাস চরের এসব জমিতে আবাদ করে সংসার চালান। এবার চরের পুরো জমিতে আবাদ করতে না পারায় তারা ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
ভূমিদস্যু বসুন্ধরা গ্রুপ তাদের নিজস্ব গণমাধ্যমে বালুচরে কোম্পানী খুললে সেখানে বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন কৃষকরা। ছালাপাকের কৃষক হাসান আলী বলেন, ‘বসুন্ধরা তিন মাস আগে কিছু সাংবাদিক নিয়া আসিয়া দেখাইছে এই জমিগুল্যা বিরান। এটে কিছু নাকি আবাদ হয় না। তোমরাই দেখো, এটে কত ফসল ফলে। ওমরা বিরান ভূমি দেখেয়া সরকারের কাছোত খাসজমি লেখি নিবার চায়। মুই প্রধানমন্ত্রীর কাছোত আবেদন করো, জমিদস্যুরা যেন জমি না পায়। হামরা কৃষকরা যেন আবাদ করি খাবার পাই।’
একই এলাকার বাসিন্দা মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘চরোত আবাদ করা গেইলে এইবার ২০ থ্যাকি ৩০ কোটি টাকার খালি আলুই আবাদ হইল হয়। এটে হামরা খিরা, বাদাম, কুমড়া আবাদ করি। ৬ মাসোত ২০০ থ্যাকি ৩০০ কোটি টাকার ফসল আবাদ হয় এটে। এইবার হামরা আবাদ কইরবার না পায়া অনেক কষ্টোত আছি। সরকার কয়, এক ইঞ্চিও জমি খালি থাকবার নয়। অ্যাল্যা জমিদস্যুরা হামার কাছোত নদীর ম্যালা জমি কাড়ি নিতোছে। কাউয়ো কিছু কয় না। হামরা কাজ না পাইলে চলিম কেমন করি, দ্যাশ কেমন করি আগাইবে।’
জমি রক্ষার আন্দোলনে দুই গ্রামের মানুষ
তিস্তার চরের জমি দখল করার ঘটনায় জীবন-জীবিকার পথহারা কৃষকরা আন্দোলনে নেমেছেন। গত ৭ ফেব্রুয়ারি আলাল চর ও চর ছালাপাক এই দুই গ্রামের পাঁচ শতাধিক নারী-পুরুষ ছালাপাকের চরের জমিতে মানববন্ধন করেন। এ সময় তারা তিস্তার বুকে জেগে ওঠা অস্থায়ী চরে বসুন্ধরার কারখানা স্থাপনের কাজ বন্ধে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কারখানার নামে চর দখল বন্ধ না হলে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা দেন কৃষকরা।
স্থানীয় বাসিন্দা ফরহাদ আলী বলেন, প্রতি বছর তিস্তার বুকে যে চর জেগে ওঠে, সেখানে আমরা আবাদ করি। এই চর কাউকে বন্দোবস্ত দেওয়ার নিয়ম নাই। কারণ বর্ষায় সেই জমি আবারও নদীর রূপ ধারণ করে। এ চরে ফসল উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প থেকে আমাদের ঋণ দেয়। ওষুধ, কীটনাশক, সারসহ নানা প্রযুক্তিও দেওয়া হয়েছে। গত বছর মিষ্টি কুমড়া আবাদের জন্য আরডিএ থেকে সোলার সেচ পাম্প দেওয়া হয়েছিল। আমরা চরে যেসব ফসল উৎপাদন করি তা সারা দেশে বিক্রি হয়। বিদেশেও যায়। এ অবস্থায় যদি নদীভাঙনের শিকার হওয়া কৃষকদের জমি কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে তাদের বেঁচে থাকার কোনো পথ থাকবে না।
৬৫ বছর বয়সি কৃষক আমিনুর রহমান বলেন, ‘বসুন্ধরা হামার মতো গরিব মাইনসেক ভাগে দিবার চেষ্টা করতোছে। আবাদ কইরবার না পায়া এইবার শত শত কোটি টাকা মরহুম হইচে। মুই সরকারের কাছে আবেদন জানাই, তোমরা একন্যা হামার ভিতি দেকেন।’
কৃষানী জেন্না বেগম বলেন, ‘চরোত ৬ মাস আবাদ করি সারা বছর চলি। এটে আবাদ কইরবার না দিলে হামরা কোটে যামো।’
প্রকল্প সম্পর্কে জানে না প্রশাসন
বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসনকে খাসজমি দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়ার জন্য আবেদন করা হলেও তাদের প্রকল্প সম্পর্কে জানে না প্রশাসন। বসুন্ধরা অয়েল এন্ড গ্যাস কোম্পানীর মাধ্যমে কীভাবে এ এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, কতজন মানুষ এখানে কাজ করতে পারবে এবং তা বর্তমান কৃষি উৎপাদনের চেয়ে এলাকাবাসী ও দেশের জন্য লাভজনক হবে কি না এসব বিষয়ে অবগত নয় প্রশাসন ও এলাকাবাসী। এলাকাবাসীকে কেবল কর্মসংস্থানের মৌখিক আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদ তামান্না বলেন, ‘ছালাপাকা ও আলাল মৌজায় বসুন্ধরা একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য খাসজমি বরাদ্দ চেয়েছে। আমি জেলা প্রশাসক স্যারের একটি চিঠি পেয়েছি। তার নির্দেশনা মোতাবেক সরেজমিন পরিদর্শন ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
‘নদী রক্ষায় প্রয়োজনে আন্দোলন’
গত বছরের ২ আগস্ট রংপুর জিলা স্কুল মাঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন। তিস্তার মাঝে জেগে ওঠা চরে বসুন্ধরার শিল্প-কারখানা স্থাপন হলে নদীর গতিপ্রবাহ বাধার সম্মুখীন হবে। সেই সঙ্গে ভাঙন বাড়বে বলে জানিয়েছেন নদীরক্ষা আন্দোলনের সংগঠক ও নদী বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, নদীর বুকে শিল্প-কারখানা স্থাপিত হলে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। পরবর্তীতে লিজ দেওয়া জমি থেকে অবকাঠোমা অপসারণ করতে সরকারকে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হবে বলেও আশঙ্কা করছেন তারা।
রিভারাইন পিপলের পরিচালক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইন, দেশ বিভাজনের পর ভূমি আইন সংস্কার, নতুন আইন, দেশের সংবিধান অনুযায়ী কোনোভাবেই নদীর জমি ব্যক্তিকে দেওয়ার সুযোগ নেই। এই জমি যদি বরাদ্দ দেওয়া হয়, তাহলে যারা বরাদ্দ দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। এর আগে তিস্তার ভেতরে স্থাপনার জন্য দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা চোখ বন্ধ করে ছিলেন। এবারও যদি চোখ বন্ধ করে থাকেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে আন্দোলন গড়ে তুলব।
রংপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান এ বিষয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘খাসজমি বন্দোবস্ত চেয়ে আমরা একটি চিঠি পেয়েছি। এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’