রাজু আহমেদ, রাজশাহী
প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০২৪ ১০:৪৮ এএম
আপডেট : ২০ মার্চ ২০২৪ ১৯:৫০ পিএম
অভিযোগ দিচ্ছেন গ্রাহকরা। ছবি : সংগৃহীত
হজে যাওয়ার জন্য জমি বিক্রি করে ২ লাখ টাকা জমিয়েছিলেন রাজশাহীর তানোর উপজেলার গোল্লাপাড়া গ্রামের বিধবা হোসনে আরা। হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় তার পা ভেঙে যায়। হজে যেতে না পেরে সেই টাকা তিনি নিজ গ্রামের পোস্ট অফিসে তিন বছরের জন্য এফডিআর করে রাখেন। সুস্থ হওয়ার পর হজে যাওয়ার জন্য গত জানুয়ারিতে তিনি টাকা তুলতে যান। কিন্তু পোস্ট মাস্টার মুখছেদ আলী তাকে নানা কায়দায় ঘুরিয়ে আসছেন।
গত ১৪ মার্চ আরও অনেকে ওই পোস্ট অফিসের সামনে জড়ো হন টাকা ফেরত নিতে। এরপর জানা যায়, হোসনে আরার মতো শতাধিক গ্রাহকের কোটি টাকা অ্যাকাউন্টে জমা না করে আত্মসাৎ করেছেন পোস্ট মাস্টার মুখছেদ আলী। ঘটনার পর গা-ঢাকা দিয়েছেন তিনি।
তা ছাড়া পোস্ট মাস্টার মুখছেদ আলীর বিরুদ্ধে তালন্দ ললিতমোহন কলেজে অনুষ্ঠিত বিএ পরীক্ষার খাতা হারিয়ে ফেলাসহ ১২ হাজার চিঠি বিলি না করে অফিসে রেখে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পোস্ট অফিসটির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, পোস্ট মাস্টার মুখছেদ আলীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা রয়েছে। এ ছাড়া তিনি অনলাইনে জুয়া খেলার সঙ্গে জড়িত।
ঘটনার পর ১৪ মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জ উপবিভাগের পোস্ট অফিসের পরিদর্শক মজিবর রহমান তানোর থানায় পোস্ট মাস্টার মুখছেদ আলীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। পুলিশ তাকে আটক করলেও আইনের ফাঁক গলিয়ে ওই দিনই বেরিয়ে গা-ঢাকা দেন মুখছেদ আলী। তানোরের ইউএনও মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ঘটনাটি দুদকের তফসিলভুক্ত হওয়ায় ওসি মামলাটি দুদকে হস্তান্তর করেছেন।’
রাজশাহী বিভাগের ডেপুটি পোস্ট মাস্টার জেনারেল মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘এ ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ডাক বিভাগ। কমিটি প্রাথমিকভাবে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করছে দুদক। মুখছেদ আলী পালিয়ে থাকলেও তাকে ধরে আনা হবে।’
তিনি আরও জানান, মাইকিং করে গ্রাহকদের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে। তাদের তথ্যের সঙ্গে অফিসের রেকর্ড মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। যাচাইকাজ অব্যাহত রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৫৫ লাখ টাকা আত্মসাতের বিষয়টি সামনে এসেছে। কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে গ্রাহকরা কবে নাগাদ তাদের টাকা ফেরত পাবেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য জানাতে পারেননি এই কর্মকর্তা।
মেয়ের বিয়ের জন্য রাখা সঞ্চয় শিগগিরই ফেরত না পেলে সস্ত্রীক আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছেন গোল্লাপাড়ার কৃষক সুখেন কুমার। তিনি বলেন, ‘আমি জমানো ৫ লাখ টাকা আমার স্ত্রীকে দিয়েছিলাম। স্ত্রী ২ লাখ টাকা গোল্লাপাড়া পোস্ট অফিসে এফডিআর করেছিল আর বাকি ৩ লাখ টাকায় সরকারি সঞ্চয়পত্র ক্রয় করেছিল। এরই মধ্যে জানতে পারলাম, আমার মতো অনেক গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়েছেন পোস্ট মাস্টার।’ সুখেন কুমার বলেন, ‘জমানো টাকাগুলো আমরা আমাদের মেয়ের বিয়ের জন্য রেখেছিলাম। টাকা ফেরত না পেলে স্ত্রীকে নিয়ে আত্মহত্যা করব।’ সঞ্চয় হারিয়ে গভীর হতাশায় পড়েছেন সুখেনের মতো আরও অনেকে।
এর আগে জেলার পবা উপজেলার কাটাখালী পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার হাসিনুর রহমানের বিরুদ্ধে একই কায়দায় কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আসে। সে ঘটনায় গত ২৫ জানুয়ারি কাটাখালী থানায় মামলা করেন রাজশাহী সদর পোস্ট মাস্টার কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. মাহফুজুর রহমান। হাসিনুর রহমান কারাগারে রয়েছেন। তবে গ্রাহকরা তাদের জমানো অর্থ এখন পর্যন্ত ফেরত পাননি।
এমন ঘটনা সামনে আসায় দেশের পোস্ট অফিসগুলোতে গ্রাহকের গচ্ছিত অর্থ নিরাপদে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এদিকে ব্যাংকিং চ্যানেলে গ্রাহকের টাকা আদান-প্রদান না করা এবং পোস্ট অফিসগুলো ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে পরিচালিত হওয়ার কারণে একের পর এক এমন ঘটনা সামনে আসছে বলে দাবি করেছেন এই কর্মকর্তা।