আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি
মেরিনা লাভলী, রংপুর
প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৪ ১৬:২২ পিএম
আধুনিক পদ্ধতিতে পাইপের মাধ্যমে বৃষ্টির মতো ফসলের ক্ষেতে সেচ দেওয়ায় কমছে জ্বালানি খরচ। রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার চরগনাই। প্রবা ফটো
রংপুরের বালুচরে ফসল উৎপাদনে উন্নত দেশের আধুনিক সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম শুরু করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। এতে পানির অপচয় রোধ হওয়ার পাশাপাশি কৃষকের শতকরা ৫০ ভাগ সেচ সাশ্রয় হচ্ছে। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে খরচ কমায় লাভবান হচ্ছেন কৃষকেরা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) রংপুর গবেষণা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রংপুরের বালুচরে ব্যাপকভাবে মিষ্টিকুমড়া, বাদাম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, ভুট্টা, গমসহ নানান ফসল আবাদ হচ্ছে। চরে ফসল আবাদে প্রধান তিনটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটি সেচ কার্যক্রম। নদীর পাশে বালুচর হলেও নদী থেকে পানি তুলে ক্ষেতে দেওয়া অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে কৃষকদের। সেই সঙ্গে সনাতন পদ্ধতিতে বালুচরে সেচ দেওয়ার মাধ্যমে ফসল আবাদে অনেক খরচ ও পরিশ্রম হয় তাদের। এমন পরিস্থিতিতে চলতি বছর বারির রংপুর গবেষণা বিভাগ জেলার কাউনিয়া উপজেলার টেপামধুপুর ইউনিয়নের চরগনাই ও কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুরের বালুচরে ১৬ জন কৃষকের জমি আধুনিক সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির আওতায় এনেছে। ‘উত্তরাঞ্চলের চর এলাকায় দক্ষ সেচ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় উন্নত দেশে প্রচলিত সেচের স্প্রিংকলার, ড্রিপ ও অলটারনেট ফারো ইরিগেশন পদ্ধতি চালু করেছে বারি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় সামাজিক নিরাপত্তা তহবিল থেকে এ কার্যক্রমে অর্থায়ন করেছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। তিনটি সেচপদ্ধতির মধ্যে স্প্রিংকলার ইরিগেশন পদ্ধতিতে পাইপের মাধ্যমে বৃষ্টির মতো পেঁয়াজ-রসুনের ক্ষেতে সেচ দেওয়া হচ্ছে। এতে ক্ষেতগুলো ভালো থাকছে এবং পেঁয়াজ-রসুনের উৎপাদনও বাড়ছে। ড্রিপ ইরিগেশন পদ্ধতিতে পানি সরবরাহ করা পাইপের বিভিন্ন স্থানে থাকা মুখের সাহায্যে মিষ্টিকুমড়ার ক্ষেতে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি দেওয়া হচ্ছে। এতে কৃষকেরা সহজেই মিষ্টিকুমড়ার গাছের গোড়ায় পানি দিতে পারছেন। ফলে সনাতন পদ্ধতিতে পানি গাছের গোড়ায় দেওয়ার পরিশ্রম কমেছে কৃষকের। এ ছাড়া আলু ও ভুট্টাক্ষেতে অলটারনেট ফারো ইরিগেশন পদ্ধতির মাধ্যমে ভুট্টা ও আলুক্ষেতে সেচ দেওয়া হচ্ছে। তিনটি পদ্ধতিতেই সেচের ক্ষেত্রে সোলার বিদ্যুতের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে কৃষকের জ্বালানি খরচ কম হচ্ছে।
চরগনাইয়ের কৃষক আব্দুল লতিফ মাস্টার বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে বালুচরে আবাদ করে আসছি। বালুচরে সেচের একটি সমস্যা থাকে। তো প্রজেক্ট থেকে আমার পেঁয়াজ ও রসুনের ক্ষেতে স্প্রিংকলার পদ্ধতিতে সেচের ব্যবস্থা করেছে। এতে করে আমার উৎপাদন খরচ কমার সঙ্গে আবাদও ভালো হচ্ছে। তবে স্প্রিংকলার পদ্ধতিতে সেচ প্রদানের জন্য পাইপসহ অন্য যে সরঞ্জামাদি দেওয়া হয়েছে সেগুলো অনেক ব্যয়বহুল। কৃষক নিজে এ পদ্ধতিতে সেচ দেওয়ার উদ্যোগ নিলে অনেক কষ্ট হবে। এক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দিলে কৃষক উপকৃত হবে।
কৃষক আলতাফ হোসেন বলেন, ‘জমিত পানি দিবার গেইলে আইল ভাঙ্গি যায়। উঁচা জমিত পানি দেওয়া যায় না। কিন্তু স্যারেরা পানির দিবার যে পদ্ধতি হামাক দেচে, এটে সহজে অসুন, পিঁয়াজ, কুমড়া ক্ষ্যাতোত পানি দিবার পারতোছি। পানিও অল্প নাগে, আবার ক্ষ্যাতও সুন্দর হইচে।’ কৃষক গোলাম হোসেন বলেন, ‘যেটে হামার ১০ হাজার টাকা পানিত খরচ হইছিল, অ্যালা সেটে ৩ হাজার টাকাত আবাদ উঠি যায়। মটর দিয়ে পানি দিলে ফিতা কিনা লাগে, অনেক সমায় ফিতা ছিঁড়ি ক্ষ্যাত নষ্ট হয়া যায়। কিন্তু এ পদ্ধতিতে হামার ম্যালা উপকার হইতোছে।’
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সেচ ও পানি ব্যবস্থা বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সুজিত কুমার বিশ্বাস বলেন, পেঁয়াজ-রসুনের ক্ষেত্রে বৃষ্টির মতো সেচ দেওয়ার জন্য আমরা স্প্রিংকলার পদ্ধতি ব্যবস্থা করছি। মিষ্টিকুমড়া, বেগুন, টমেটোর জন্য ফোঁটায় ফোঁটায় পানি সেচ দেওয়ার জন্য ড্রিপ ইরিগেশন পদ্ধতি এবং ভুট্টাক্ষেতে সেচের জন্য অলটারনেট ফারো ইরিগেশন পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে কৃষকের শতকরা ৫০ ভাগ সেচ খরচ সাশ্রয় হচ্ছে।
প্রকল্প সমন্বয়কারী ড. আব্দুর রাজ্জাক আকন্দ বলেন, প্রকল্প শেষ হওয়ার পরও যেন এ আধুনিক সেচ কার্যক্রম অব্যাহত থাকে, সে লক্ষ্যে কৃষকদের গ্রুপ তৈরি করা হবে। প্রতিটি গ্রুপে ২০ জন করে কৃষক থাকবে। প্রকল্প শেষ হলেও আমরা আশা করছি তারা নিজ ব্যবস্থাপনায় এ সেচ কার্যক্রম চালু রাখবে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল আলম বলেন, যেসব প্রযুক্তি উদ্ভাবন হয়েছে কিন্তু কৃষক পর্যায়ে এখনও জনপ্রিয় হয়নি সেসব প্রযুক্তি মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এতে করে কৃষির সার্বিক উন্নয়ন হবে এবং দেশে খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ভূমিকা রাখবে।