× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

জাহাজপুরার গর্জনবাগান অপহরণের অভয়ারণ্য

নুপা আলম, কক্সবাজার

প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৪ ১৫:০৯ পিএম

আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২৪ ১৫:২৩ পিএম

জাহাজপুরার গর্জনবাগান পাহাড়ি এলাকা। ফাইল ফটো

জাহাজপুরার গর্জনবাগান পাহাড়ি এলাকা। ফাইল ফটো

জাহাজপুরার গর্জনবাগান পাহাড়ি এলাকা। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী উপজেলা টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের এই পাহাড়ে এখন কেবল প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য নয়, রয়েছে বিপদেরও হাতছানি। গত এক বছরেরও বেশি সময় একের পর এক অপহরণ ঘটছে এখানে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের মার্চ মাস থেকে চলতি ২০২৪-এর মার্চ পর্যন্ত টেকনাফের এই পাহাড়কেন্দ্রিক এলাকায় ঘটেছে অপহরণের ১০১টি ঘটনা। অপহৃতদের ৫১ জন স্থানীয়, রোহিঙ্গা ৫০ জন। মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন এদের ৪৬ জন।

টেকনাফের এই বিপদসঙ্কুল পাহাড়ি এলাকার পূর্ব দিকে নাফ নদী। এই নদী উখিয়া উপজেলা হয়ে মিশে গেছে বান্দরবানের ঘুমধুম-তুমব্রু এলাকায়। পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। পূর্বের টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন থেকে পশ্চিমের বাহারছড়া ইউনিয়নের এই পাহাড়ের সরাসরি দূরত্ব সর্বোচ্চ ১০ কিলোমিটার। আবার উত্তর দিকের হোয়াইক্যং-বাহারছড়া সড়ক আর দক্ষিণের লেঙ্গুরবিল, লম্বরী, নতুন পল্লান পাড়া, পুরতান পল্লান পাড়া ও উপজেলা পরিষদ পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার জুড়েও বিস্তৃত পাহাড়। টেকনাফ হয়ে কক্সবাজার-টেকনাফ আঞ্চলিক সড়ক দিয়ে উত্তরের দিকে এগোলে পশ্চিম অংশে অল্প কিছু বসতি মিললেও মূলত এটি পাহাড়ি এলাকাÑ যা গিয়ে মিশেছে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। এখানে পাহাড়ের বিস্তৃতি ৬০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। টেকনাফের এই পাহাড় ঘিরেই ঘটছে নানা অপহরণের ঘটনা। মাদক ব্যবসার কারণেই ঘটছে বেশিরভাগ অপহরণ।

সর্বশেষ অপহরণ পূর্ব পানখালীতে

এর মধ্যে সর্বশেষ গত শনিবার দুপুরে অপহৃত হয়েছে টেকনাফের মাদ্রাসাপড়ুয়া ছয় বছরের শিশুশিক্ষার্থী ছোয়াদ বিন আব্দুল্লাহ (৬)। এখনও তার কোনো খোঁজ মিলেনি। অপহরণকারীদের পক্ষ থেকে কেউ কোনো যোগাযোগও করেনি। ছোয়াদ বিন আব্দুল্লাহ টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের পূর্ব পানখালী এলাকার মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর ছেলে। সে একই এলাকার আবু হুরাইরা (রাঃ) মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণির ছাত্র।

ভুক্তভোগী শিশুর মা নুরজাহান বেগম বলেন, হ্নীলা ইউনিয়নের পূর্ব পানখালী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা রাহমত উল্লাহ, সাদিয়া, আব্দুর রহিম, শাহ আলম, নুর আলমসহ কয়েকজনের সঙ্গে তাদের পরিবারের দীর্ঘদিনের বিরোধ রয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে অপহরণ, প্রাণনাশসহ নানা ধরনের হুমকিও দিয়ে আসছে। এর জের ধরে তার সন্তানকে অপহরণ করা হয়েছে বলে ধারণা তার। তবে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কেউ কোনোভাবে যোগাযোগ না করায় উৎকণ্ঠিত তারা।

টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ ওসমান গনি জানান, পুলিশ ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। দেখা গেছে, শিশুটিকে এক নারী অটোরিকশায় তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সিসিটিভি ফুটেজের ওই নারীসহ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার এবং শিশুটিকে উদ্ধারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।

কেন এসব অপহরণ

এক বছরে ১০১টি অপহরণের ঘটনার ধরন, অপহৃত ব্যক্তি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেওয়া তথ্য বলছে, টেকনাফকেন্দ্রিক অপহরণের নেপথ্যে রয়েছে তিন ধরনের কারণ। যার একটি হলো, মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা মাদক ইয়াবার লেনদেন। দ্বিতীয় কারণ হলো, সাগরপথে মানব পাচারকারী চক্রের প্রলোভন। তৃতীয়ত, সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে মুক্তিপণ আদায়ের জন্যও একই চক্র সারা বছর ধরে করে চলেছে অপহরণ। 

মাদকের পাওনা উদ্ধারের হাতিয়ার

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের আশপাশের এলাকায় রয়েছে ৩০টির বেশি ইয়াবা কারখানা। এসব কারখানা থেকে শুধু বাংলাদেশে পাচারের উদ্দেশ্যেই ইয়াবা উৎপাদিত হয়। 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন, ইয়াবা কারবারে জড়িত ব্যক্তি এবং অপহৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে চোরাইপথে আসা এসব ইয়াবা মূলত বাকিতেই পাঠানো হয়। ইয়াবা বিক্রি করে টাকা পরিশোধের শর্তেই আনা হয় এসব মাদক। 

সর্বশেষ গত বছরের ২২ ডিসেম্বর র‌্যাব পরিচালিত এক অভিযানের পর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের ওই সময়ের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এএইচ সাজ্জাদ হোসেনও জানিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে শতভাগ বাকিতে বাংলাদেশে আনা হয় মাদকের চালান। এসব মাদক নির্ধারিত এজেন্টের কাছে বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করে জমানো হয় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে। ব্যবসায়ীরা যা বিভিন্ন কোম্পানির বিক্রয়কর্মীদের মাধ্যমে টেকনাফের সংঘবদ্ধ হুন্ডি কারবারিদের কাছে পাঠায়। আর হুন্ডি কারবারিরা টেকনাফের বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ঢাকা, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের কাছে পাঠিয়ে দেন। এই টাকা এখানে আসার পর ডলারে রূপান্তরিত হয়ে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া হয়ে পৌঁছে যায় মিয়ানমারে অবস্থানরত মাদকের ডিলারদের কাছে।

গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ইয়াবা কারবারে কেউ টাকা আত্মসাতের চেষ্টা করলে সেই টাকা উদ্ধারের জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক সন্ত্রাসী চক্রের সদস্য এবং ইয়াবা কারবারিরা তাকে বা সেই চক্রের কাউকে অপহরণ করে টাকা আদায় করে থাকে। 

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে অপহৃত হন টেকনাফ পৌরসভার ডেইল পাড়ার শফিক (ছদ্মনাম)। তবে কক্সবাজার জেলা পুলিশের কাছে এ-সংক্রান্ত কোনো রেকর্ড বা তথ্য নেই। পরিচয় গোপন করার শর্তে এই যুবক জানিয়েছেন, ইয়াবার চালানের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। মিয়ানমারের মংডু থেকে টেকনাফের মৌলভীপাড়া সীমান্ত দিয়ে তিনি ইয়াবার একটি চালান এনেছিলেন। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিজিবি সদস্যরা এটি আটক করে। কিন্তু মিয়ানমারের ডিলারের কাছে তিনি ইয়াবার চালান আটকের প্রমাণ, যেমন সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছবিসহ সংবাদের কপি দিতে ব্যর্থ হন। এ কারণে তাকে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রফিকের মাধ্যমে ইয়াবার আরেকটি চালান নিয়ে লাভ করার ফাঁদে ফেলা হয়। রফিকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অপহৃত হন তিনি। প্রথমে রোহিঙ্গা ক্যাম্প, পরে পাহাড়ের গহিনের আস্তানায় রেখে তার ওপর ধারাবাহিক নির্যাতন চালানো হয়। তার পিতা এবং মালয়েশিয়ায় থাকা ছোট ভাইয়ের সহযোগিতায় টাকা পরিশোধ করে টানা আট দিন পর মুক্তি পান তিনি। বিষয়টি মাদকসংশ্লিষ্ট হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কিছু জানাননি তিনি। 

অবশ্য অপহরণের নেপথ্যে মাদকের লেনদেনের প্রমাণ রয়েছে পুলিশের কাছেও। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে টেকনাফে এসে ঢাকার সাভার পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মুখার্জিপাড়ার সিরাজুল ইসলামের ছেলে আরিফুল ইসলাম অপহৃত হয়েছেনÑ এমন অভিযোগে একটি মামলা হয়। মামলায় বলা হয়, ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার শুভাঢ্যা ইউনিয়নের বাসিন্দা বন্ধু মো. সুমনের সঙ্গে টেকনাফ বেড়াতে যান তিনি। এখানে এসে অপহৃত হন আরিফুল। পুলিশ টেকনাফ পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নিজামুদ্দিনের বাড়ির ভাড়াটে সলিমুল্লাহর বাসার একটা তালাবদ্ধ ঘর থেকে তাকে উদ্ধার করে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম জানান, আরিফুলের বন্ধু সুমন তাকে বন্ধক রেখে ইয়াবার একটি চালান ঢাকায় এনে বিক্রি করেন। বিক্রির পর টাকা পরিশোধের কথা থাকলেও তাতে দেরি হয়ে যায়। ইতোমধ্যে বন্ধক রাখা আরিফকে আটকে ফেলে তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। সঠিক সময়ে ইয়াবার টাকা পেলে বিষয়টি জানাজানি হতো না। 

শুধু এই একটি বা দুটি ঘটনা নয়Ñ মানুষ বন্ধক রেখে ইয়াবার চালান আনা এবং পরে একে কেন্দ্র করে অপহরণ ঘটনার একাধিক মামলা রয়েছে।

২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা গর্জনবাগান পাহাড় থেকে অপহরণ করা হয় ওই এলাকার আট ব্যক্তিকে। অপহৃত আট ব্যক্তিরই দাবি, পাহাড়ের খালে মাছ ধরতে গিয়ে তারা অপহৃত হন এবং চার দিন পর ২১ ডিসেম্বর রাতে ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসেন। তবে পুলিশের তদন্ত বলছে, এই আটজনের অপহরণের নেপথ্যে রয়েছে মাদক বেচা-বিক্রির ভিন্ন গল্প। অপহৃতরা অবশ্য পুলিশের এই তদন্ত মানতে রাজি নন। তাদের মতে, সন্ত্রাসীরাই অপহরণ করেছিল।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম জানান, ইয়াবা লেনদেনের জের ধরে কিছু ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। যা অপহরণ বা মুক্তিপণ আদায় হিসেবে ধরা হলেও পরে তদন্ত করে দেখা গেছে মাদকসংশ্লিষ্ট। টেকনাফ বা উখিয়ায় টাকার বদলে একজনকে বন্ধক রেখে ইয়াবা নিয়ে আসা হয়। ইয়াবা দেওয়ার সময় বলা হয়, বিক্রি করে টাকা সঠিক সময় না দেওয়া হলে জিম্মি রাখা মানুষকে হত্যা করা হবে। এটা ব্যবসার নতুন কৌশল। এটার সঙ্গে একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত। যাদের আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে।

সাগরপথে মানব পাচার

কক্সবাজারের সাগরপথে অবৈধভাবে মানব পাচার নতুন ঘটনা নয়। উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে মানব পাচারের শুরু ২০১০ সালে। ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডের গহিন পাহাড়ে গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী হইচই শুরু হয়। তার পরও সক্রিয় রয়েছে সেই মানব পাচার চক্রটি। ফলে থেমে নেই মানব পাচার চক্রের অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা।

এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে। ৩ সেপ্টেম্বর বিকালে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুরের মো. হোসেন আলীর ছেলে ১৬ বছরের কিশোর মো. হাবিব উল্লাহর সঙ্গে পরিচয় হয় টেকনাফের এক যুবকের। হাবিব সৈকতে আনার ফল বিক্রি করত। 

পুলিশের কাছে হাবিবের পিতা হোসেন আলীর দায়ের করা অভিযোগে বলা হয়, হাবিবকে অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে। একই সময়ে কক্সবাজার সদর থানায় আরও একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছিল। ওই জিডিতে চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের স্টেশন পাড়ার আবদুর রহমান উল্লেখ করেন, তার ছেলে রায়হান উদ্দিন (২৮) সৈকতে হকার হিসেবে খাদ্যপণ্য বিক্রি করত। তবে সে এখন নিখোঁজ। 

এই দুইটি জিডির সূত্র ধরে তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ ২৪ সেপ্টেম্বর ভোরে উদ্ধার করে হাবিব, রায়হানসহ সাতজনকে। 

ওই দিনই সংবাদ সম্মেলনে কক্সবাজার সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার সদর থানায় লিপিবদ্ধ হওয়া দুইটি সাধারণ ডায়েরির তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয়, একটি সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী চক্র কক্সবাজার সদর, চকরিয়া, মহেশখালী এবং উখিয়ার কিছু কিশোর ও যুবককে নানা প্রলোভন দেখিয়ে উন্নত জীবনের কথা বলে মালয়েশিয়া পাচারের উদ্দেশ্যে জিম্মি করে। তাদের প্রথমে টেকনাফের লেঙ্গুর বিল এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সাগরপথে মিয়ানমারের একটি আস্তানায় নিয়ে গিয়ে জিম্মি করা হয়। ওখানে তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে ফোনে স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা দাবি করে। স্বজনরা নির্যাতনের খবর পেয়ে নানাভাবে পাচারকারীদের বিভিন্ন অঙ্কের টাকাও প্রদান করে। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় পুলিশ এই টাকা গ্রহণকারী লোকজন ও পাচারকারী চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করে চারজনকে গ্রেপ্তার করে। এরপর গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কৌশলে ব্যবহার করে ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে মিয়ানমার থেকে টেকনাফের সমুদ্রসৈকত এলাকায় অপহৃত সাতজনকে ফিরিয়ে আনা হয়। সেখান থেকে পুলিশ উদ্ধার করে তাদের।

২৫ সেপ্টেম্বর ভোরে শুধু এই সাতজন ফেরেননি। একই প্রক্রিয়ায় পৃথকভাবে ফিরেছেন চট্টগ্রামের আরও চার কিশোরও। এর মধ্যে ৫৪ দিন পর ঘরে ফিরেছিলেন চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানার আব্দুর শুক্কুরের ছেলে আনসারুল করিম। চার কিশোরকে ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে টেকনাফের লম্বরীঘাট এলাকায় রেখে যায় অপহরণকারীরা। পরে পুলিশ গিয়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে। বাকলিয়া থানার ওসি আব্দুর রহিম জানান, এ ঘটনায় আবদুল করিমসহ যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয় তারা মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা। 

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং গবেষক আসিফ মুনীর জানান, মানব পাচারে শক্তিশালী একটি চক্র জড়িত। যারা ট্রলারে মানুষ তুলে দিয়ে নগদ অর্থ পায়। যাদের মিয়ানমার বা থাইল্যান্ডে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো এবং আঞ্চলিক রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে আলোচনা জরুরি। মানব পাচারের ঘটনায় ২০১৫ সালে যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলোর বিচার নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে উঠেছে। না হলে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

কক্সবাজার আদালত ও কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্যমতে, কক্সবাজারের বিভিন্ন থানা ও আদালতে ৬৫০টির বেশি মানব পাচারের মামলা রয়েছে। এসব মামলায় আসামি এক হাজারের বেশি। এর মধ্যে বর্তমানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এ ৩৩০টি, ট্রাইব্যুনাল-২-এ ৫৮টি এবং ট্রাইব্যুনাল-৩-এ ২৬০টি বিচারাধীন মামলা রয়েছে। বাকি ১৬টি মামলা খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। ২০১২ সালের পর থেকে হওয়া এসব মামলার একটিরও বিচার হয়নি।

কক্সবাজার জেলা দায়রা ও জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম বলেন, ‘মানব পাচার জঘন্য একটি অপরাধ। কিন্তু বিচারক সংকট ও নানা কারণে এখন পর্যন্ত একটি মামলার বিচারও শেষ করতে পারিনি আমরা। তবে আদালত মানব পাচার মামলাগুলো দ্রুত বিচার শেষ করার উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন বিচারক নিয়োগ দিয়েছে সরকার।’

টার্গেট অপহরণে মুক্তিপণ

এসব অপহরণের পাশাপাশি টার্গেট অপহরণ করেও মুক্তিপণ আদায় করে থাকে একই চক্র। এমন অপহরণের শিকার হতে হয় পাহাড়ের আশপাশের কৃষকসহ সাধারণ মানুষদের। নানা কৌশলে মানুষকে পাহাড়ের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে জিম্মি করা হয়। 

এমন একটি অপহরণের কথা জানা যায় ২০২১ সালের ২৯ জুন। ওই দিন হোয়াইক্যং-বাহারছড়া সড়ক থেকে অপহরণ করা হয় বাহারছড়ার উত্তর শিলখালী এলাকার মৃত ছালেহ আহমেদের ছেলে সিএনজিচালক মোহাম্মদ করিমকে। এরপর ফোনে মুক্তিপণের টাকা দাবি করা হয়। পরিরারের লোকজন ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণও দেন। কিন্তু ছেড়ে দেওয়া হয়নি। পরে ১২ আগস্ট বন বিভাগ থেকে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করার সময় পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা একটি মাথার খুলি ও কঙ্কাল দেখতে পান। মরদেহের কাপড়, বেল্ট ইত্যাদি দেখে সেটিকে করিমের মরদেহ হিসেবে শনাক্ত করা হয়। 

বাহারছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক আবুল মঞ্জুর জানান, এই পাহাড়টিতে যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে সহজেই সশস্ত্র সন্ত্রাসী আটক করতে পারে। কিন্তু তা করা হচ্ছে না। আর এ অপহরণের ঘটনায় যুক্ত হচ্ছে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয়রাও। তাদের শনাক্তের দাবি জানান তিনি।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা