আবু রায়হান তানিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৪ ১৩:৫৫ পিএম
হরিজন সম্প্রদায় থেকে দেশের প্রথম আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত কৃষ্ণ দাশকে গাউন পরিয়ে দেন চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আজিজ আহমেদ ভূঁইয়া। ছবি : সংগৃহীত
‘আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন ছিল। সেটা বাস্তব হবে, আবার আইনজীবী হওয়ায় এভাবে আমাকে জেলা জজ মিলনায়তনে সংবর্ধনা দেওয়া হবে স্বপ্নেও ভাবিনি। আজকের দিনটা আমার জন্য গর্বের। শুধু আমার জন্য না, আমার সম্প্রদায়ের সব মানুষের জন্যই গর্বের।’
চট্টগ্রাম জেলা জজ মিলনায়তনে সংবর্ধনা পাওয়ার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে একনাগাড়ে কথাগুলো বললেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় সদ্য আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়া কৃষ্ণ চন্দ্র দাশ। হরিজন সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে কৃষ্ণ চন্দ্রই প্রথম ব্যক্তি যিনি আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেন।
বাংলাদেশে বসবাসকারী অবাঙালি দলিতদের সাধারণত হরিজন বলা হয়।ব্রিটিশ আমলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ, পয়োনিষ্কাশন সংক্রান্ত কাজের জন্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাদের এই দেশে আনা হয়। সাধারণত পরিচ্ছন্নতা কাজে সেবা দেওয়া এই মানুষদের সমাজে অচ্ছুত হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। তাদের কাছ থেকে সেবা নিলেও তাদের ধরাছোঁয়া যাবে না- এমন একটা প্রথা ছিল কট্টরভাবেই। সেই চিত্র বদলাতে মহাত্মা গান্ধী তাদের নাম দিয়েছিলেন হরিজন; অর্থাৎ ঈশ্বরের আত্মা। চট্টগ্রামে এই হরিজনদের অবশ্য ভিন্ন একটা নাম দিয়েছেন প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি তাদের নাম দিয়েছেন সেবক। দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন তাদের সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠায়।
সেই সেবকদের এক সন্তান আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ায় চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালতে সংবর্ধনার আয়োজন করে জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) কার্যালয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে কৃষ্ণ চন্দ্রকে গাউন পরিয়ে দেন জেলা ও দায়রা জজ ড. আজিজ আহমেদ ভূঁঞা।
এতে সভাপতিত্ব করেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর অন্যতম সহচর জেলা পিপি ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী। এ সময় জেলা জজ মিলনায়তনে উপস্থিত ছিলেন কৃষ্ণ চন্দ্র দাশের মা ছায়া দাশসহ হরিজন সম্প্রদায়ের আরও ছয়জন। যারা কৃষ্ণ চন্দ্র দাশের বন্ধু।
আয়োজনটিকে বিশেষ হিসেবে অভিহিত করে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা ও দায়রা জজ ড. আজিজ আহমেদ ভূঁঞা বলেন, ‘দেশে প্রথম হরিজন সম্প্রদায়ের একজন সন্তান আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেন। তাকে সংবর্ধিত করার মাধ্যমে আজকে একটা বিষয় স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া গেল যে, আমাদের দেশে সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার আছে। এটা আমাদের সবার জন্য সম্মানের ও গর্বের।’
স্বপ্ন ডানা মেলে মহিউদ্দিন চৌধুরীর হাত ধরে, পূর্ণতা দেন ইফতেখার সাইমুল
চট্টগ্রামের বান্ডেল কলোনি সেবক গলির বাসিন্দা কৃষ্ণ চন্দ্র দাশের বাবা প্রয়াত চিরঞ্জীব দাশ ও মা ছায়া দাশ। দুজনই সিটি করপোরেশনের সেবক ছিলেন। সেখানকার মিউনিসিপ্যাল স্কুল থেকে এসএসসি ও ইসলামিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও ‘চট্টলবীর’খ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরামর্শে কৃষ্ণ চন্দ্র দাশ ভর্তি হন বেসরকারি প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটিতে।
সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে কৃষ্ণ বলেন, “এইচএসসির পর কী করব সে সিদ্ধান্ত নিতে বাবা আমাকে চট্টলবীর মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছে নিয়ে যান। তিনি বাবাকে বলেন ‘তোমাদের সম্প্রদায়ে তো অনেক সমস্যা। আইনজীবী দরকার। ছেলেকে আইনজীবী বানাও।’ তারপর উনি আমাকে বিনা বেতনে প্রিমিয়ারে ভর্তি করিয়ে দিলেন। সেখানে কোনো সেমিস্টার ফি ছাড়াই পড়াশোনা করেছি আমি। শুধু পরীক্ষার ফিটা দিয়েছি।”
এই যাত্রায় পিপি ইফতেখার সাইমুলের ভূমিকার কথা স্মরণ করে কৃষ্ণ চন্দ্র দাশ বলেন, ‘২০১৭ সালে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী মারা যান। আমার আইন পড়া শেষ হয় ২০১৮ সালে। সাইমুল স্যার সব সময় খোঁজখবর রেখেছেন। পাস করার পর উনার চেম্বারে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন। কোনোদিন বুঝতে দেননি আমি হরিজনদের কেউ। ওনার সঙ্গে এক টেবিলে বসেও খাইয়েছেন। কারও কাছে আমার পরিচয় জানাতে দেননি।’
কৃষ্ণ চন্দ্র দাশকে নিয়ে পিপি ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ছাত্রজীবনে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে হরিজন সম্প্রদায়ের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। একটা সময় ছিল তাদের কাছে লোকজন চা পর্যন্ত বিক্রি করত না। এই ধারাটা পরিবর্তনের জন্য কাজ করার স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হচ্ছে দেখে ভালো লাগছে।’
কৃষ্ণ চন্দ্রের সফলতায় মা ছায়া চন্দ্র বলেন, ‘ছেলেটা অনেক কষ্ট করেছে। এখন সফল হয়েছে। আজ জজ সাহেব কালো জামা পরিয়ে দিল, ফুল দিল। ভালো লাগছে। এমন দিন দেখার পর জীবনে আর কোনো দুঃখ থাকবে না।’
স্বপ্নের পরিধি আরও বড় করতে চান জানিয়ে কৃষ্ণ চন্দ্র দাশ বলেন, ‘এই স্বপ্ন যেহেতু বাস্তব হলো, এখন স্বপ্ন দেখছি হাইকোর্টে আইনজীবী হওয়ার।’