এস এম রানা ও হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৪ ০১:০৩ এএম
আপডেট : ১৫ মার্চ ২০২৪ ১০:৫৬ এএম
ভারত মহাসাগর থেকে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে ছিনতাইয়ের শিকার বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ কয়লা নিয়ে মোজাম্বিক থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাচ্ছিল। কয়লার মতো বিপজ্জনক বস্তুর কারণে নাবিকদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে বলে মনে করছেন এ বিষয়ে অভিজ্ঞজনরা। এদিকে অপহৃত জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ ও ২৩ নাবিককে নিয়ে সোমালিয়া উপকূলে পৌঁছে গেছে জলদস্যুরা। গত মঙ্গলবার দুপুর থেকে বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) দুপুর পর্যন্ত ৪৫৫ নটিক্যাল মাইল পাড়ি দিয়ে জলদস্যুরা নিজেদের নিয়ন্ত্রিত জলসীমায় পৌঁছেছে। এছাড়া বৃহস্পতিবার সকাল নাগাদ জাহাজের নাবিকদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে বলে জানিয়েছে জাহাজ মালিকপক্ষ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি যুদ্ধজাহাজ অপহৃত জাহাজটিকে অনুসরণ করছে বলে জানিয়েছে ইইউর সামুদ্রিক নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃপক্ষ। এদিকে এমভি আব্দুল্লাহ ও এর নাবিকদের মুক্তি দিতে কেউ এখনও মুক্তিপণ চেয়ে যোগাযোগ করেনি বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এছাড়া জিম্মি হওয়া নাবিকদের পরিবারগুলোর সময় কাটছে ভীষণ উদ্বিগ্নতায়।
জাহাজে কয়লা, নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন
কয়লা বহনকারী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর নাবিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন এ-বিষয়ক সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আনাম চৌধুরী জানিয়েছেন, কয়লা একটি বিপজ্জনক কার্গোপণ্য। অতিরিক্ত তাপমাত্রায় কয়লা নিজ থেকেই বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। তাই কয়লাবাহী কার্গো জাহাজের তাপমাত্রা ২৪ ঘণ্টা মনিটর করতে হয়। তিনি বলেন, ‘সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়া এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজটির তাপমাত্রা মনিটর করে যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা না হয়, তাহলে বিস্ফোরণের আশঙ্কা রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কয়লাবাহী কার্গোতে আমি চাকরি করেছি। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, জাহাজে কয়লা থাকায় এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজের নাবিকরা প্রকৃতপক্ষেই বিপদজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। তাদের যত দ্রুত উদ্ধার করা হবে, ততই মঙ্গল। কারণ জলদস্যুরা কার্গো মেইন্টেনেন্সের কাজগুলো যদি করতে না দেয়, তাহলে এটি অবশ্যই খারাপ কিছু বয়ে আনবে।’
৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে জাহাজটি মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের হামরিয়াহ বন্দরে যাচ্ছিল।
এদিকে উদ্ধার তৎপরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে কেএসআরএমের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, আমাদের কাছে সর্বশেষ যে তথ্য আছে, সেটি হলো জলদস্যুরা হাইজ্যাক করার পর আজ (গতকাল) দুপুর ২টা নাগাদ জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলে নিয়ে গেছে। এখন জাহাজটি সেখানে রয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে তারা এখনও কোনো দাবিদাওয়া জানায়নি। তবে জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে আমরা ইতোমধ্যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। জাহাজটির কেঅ্যান্ডআর ইন্স্যুরেন্স করা আছে। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিও জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে কাজ করছে।’
জলদস্যুরা এখনও কোনো দাবি না করায় জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারের বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। তাই জিম্মি নাবিকরা কবে নাগাদ উদ্ধার হতে পারে, সেটি নিয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে এ ধরনের ঘটনায় জিম্মিদের উদ্ধার করতে সাধারণত ৯০ দিন থেকে এক বছর সময় লেগে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এত সময় লাগলে তারা কীভাবে কয়লাবাহী জাহাজে এতদিন থাকবেন, সেটি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন স্বজনরা। কয়লা বিপজ্জনক পণ্য হওয়ায় অতিরিক্ত তাপমাত্রায় এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।
ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম সলিড বাল্ক কার্গোস (আইএমএসবিসি) কোড অনুযায়ী, কয়লার তাপমাত্রা যদি ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হয়, তখন কার্গোতে কয়লা লোড দেওয়া যাবে না। কারণ কয়লার তাপমাত্রা ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে ধরে নেওয়া হয় এটি সেল্ফ হিটিংয়ের জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। কয়লা পরিবহনের ক্ষেত্রে লোডিংয়ের পর হোল্ড ২৪ ঘণ্টা ভেন্টিলেটেড করতে হবে। যদি এটি করা না হয়, তাহলে কয়লা সেল্ফ হিটেড হয়ে যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়লা পরিবহনের ক্ষেত্রে সচরাচর যেসব সমস্যা দেখা দেয় তার মধ্যে অন্যতম হলো নিজে নিজে জ্বলে ওঠা (সেল্ফ হিটিং), অন্যটি হলো- জ্বালানি গ্যাস। সেল্ফ হিটিং থেকেই অনেক সময় আগুন ধরে যায়। এছাড়া কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদন, মিথেন গ্যাস মিলে তৈরি হয়ে জাহাজের হোল্ডের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য কাজী মোহাম্মদ আবু সাঈদ বলেন, এ ধরনের কার্গো ২৪ ঘণ্টা মনিটর করতে হয়। কারণ মনিটরিং করে মিথেন বের করতে হয়। কয়লার কার্গোর তাপমাত্রা বাড়লে সেখানে মিথেন তৈরি হয়। মনিটরিং করে মিথেন গ্যাস বের করে না দিলে সেটি বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। মনিটরিং করে নিয়মিত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা না হলে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বিশেষ করে মিথেন গ্যাস খুব ভয়ংকর। মিথেনের মাত্রা বাড়লেই সেটি বিস্ফোরণ ঘটাবে।
তিনি আরও বলেন, আশঙ্কার বিষয় হলো, যারা জলদস্যু তারা এ সম্পর্কে না-ও জানতে পারে। জাহাজে থাকা নাবিকরা দস্যুদের বুঝিয়ে যদি হিট মনিটরিংটা নিয়মিত করতে না পারেন, তাহলে কয়লার তাপমাত্রা থেকে জাহাজে বিস্ফোরণ ঘটার সম্ভাবনা থাকবে। কারণ আফ্রিকান দেশগুলোর ওই অংশে সূর্যের তাপমাত্রা বেশি থাকে।
জাহাজটির কিডন্যাপ অ্যান্ড র্যানসম (কেঅ্যান্ডআর) ইন্স্যুরেন্স করা আছে। তাই জাহাজটির নাবিকদের উদ্ধারে কিছুটা বিলম্ব হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মার্চেন্ট মেরিনাররা বলছেন, কিডন্যাপ অ্যান্ড র্যানসম ইন্স্যুরেন্স করা থাকলে জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে বীমা কোম্পানি।
জিম্মি নাবিকদের যেভাবে উদ্ধার করা হয়
একাধিক মার্চেন্ট মেরিনারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাহাজটি অপহরণের পর জলদস্যুরা তাদের ডেরায় নিয়ে যায়। এরপর তারা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করবে। কোম্পানির কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, সেটি জাহাজে লেখা থাকে। কোম্পানির নির্ধারিত ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের দাবি জানাবে। এরপর শুরু হবে দরকষাকষি।
তারা আরও জানান, কিডন্যাপ হওয়া জাহাজটির যদি ইন্স্যুরেন্স করা থাকে, তাহলে জাহাজটি উদ্ধারে থার্ড পার্টি হিসেবে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি এর সঙ্গে যুক্ত হবে। তখন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি সরাসরি জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। জলদস্যুরা সচরাচর নগদ টাকা নেয়। এটি সাগর, স্থল বা আকাশপথে তাদের কাছে পৌঁছানো হয়। এর আগে যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, সেখান থেকে দেখা যায় আকাশপথেই জলদস্যুদের মুক্তিপণের টাকা দেওয়া হয়। নিচ দিয়ে চলা একটি উড়োজাহাজে করে জলদস্যুদের নির্ধারিত স্থানে মুক্তিপণ নিচে ফেলা হয়। এরপর তারা সেটি গ্রহণ করে। সন্তুষ্ট হলে তখন জাহাজ ছেড়ে দেয়।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, এই ক্ষেত্রে জলদস্যুদের সৎ দেখেছি। মুক্তিপণ নিয়ে নাবিকদের মেরে ফেলেছে। অথবা জাহাজটি ছেড়ে দেয়নিÑ এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
কতদিন সময় লাগবে জানতে চাইলে আনাম চৌধুরী বলেন, ‘অপহরণের পর নাবিকদের উদ্ধার করতে ৯০ দিন থেকে সর্বোচ্চ এক বছর সময় লেগে যায়। চাইলে এটি ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যেও সম্ভব। এটি নির্ভর করবে দরকষাকষির ওপর।’
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় স্বজনরা
ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে বন্দি তারেকুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে চলছে আহাজারি। মধুখালীর রায়পুর ইউনিয়নের ছকড়িকান্দি গ্রামের বাড়িতে তার পরিবার উদ্বিগ্ন সময় পার করছে। তার মা হাসিনা বেগম বলেন, ছোটবেলা থেকে আমার ছেলে নামাজ-রোজা কামাই করেনি। ছেলের জন্য কষ্ট হচ্ছে। আমি আমার সোনার ছেলেকে ফিরে পেতে চাই।
ছকড়িকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রাধা রানী ভৌমিক বলেন, ভারত মহাসাগরের সোমালিয়ায় ২৩ নাবিককে জলদস্যুরা কিডন্যাপ করেছে, এর মধ্যে আমার ছাত্র তারেকুলও আছে। সে মেধাবী ছাত্র। প্রধানমন্ত্রীর কাছে চাইব তারেকুলসহ সবাইকে যেন সশরীরে সুস্থভাবে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।