মেহেদী হাসান শিয়াম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৪ ১৭:০৮ পিএম
নারীরা দলবেঁধে নকশিকাঁথা-ওড়না বুননের কাজ করছেন। বৃহস্পতিবার শিবগঞ্জের ধাইনগর এলাকা থেকে তোলা। প্রবা ফটো
চাঁপাইনবাবগঞ্জে গত কয়েক বছর ধরে বাড়ছে নারী উদ্যোক্তা। সরকারি দপ্তরগুলোয় প্রশিক্ষণ নেওয়ার পাশাপাশি অন্যের সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অনলাইন ও সরাসরি পণ্য বেচাকেনায় ঝুঁকছেন নারীরা। অনেকেই পারিবারিক সহায়তায় হয়েছেন সফল আবার অনেক নারী নানা বাঁধাতেও লড়ছেন এই পথে। হয়েছেন সফলও।
অনলাইন ও সরাসরি পণ্যসামগ্রী বিক্রি করে নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তি প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে তুলছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তৃণমূলে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে নারীরা জড়াচ্ছেন বেচাকেনার এই উদ্যোগে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাঁচটি উপজেলা। এরমধ্যে সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলায় নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বেশি রয়েছে। এখানকার নারীরা আম, আম দিয়ে বানানো প্রায় ১০ রকমের আচার, বুটিক জিনিসপত্র, আটার নাড়ু, ছাতু, কুমড়ো বড়ি, মাথায় ও গায়ে মাখা তেল, কেক, আখের গুড়সহ নানা সামগ্রী বানিয়ে বিক্রি করছেন। এমন নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা জেলায় সাড়ে ছয় শতাধিক।
নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাকালীন সময় থেকে জেলায় বাড়ছে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা। গত দুই বছরের ব্যবধানে জেলায় বেড়েছে প্রায় তিন শতাধিক নারী উদ্যোক্তা। তাদের বেশিরভাই এখন প্রতিষ্ঠিত। অনলাইন পণ্য বেচাকেনা আর দক্ষতা কম থাকায় অনেকই এ উদ্যোগে জড়িয়েও অনিয়মিত এমন ‘উদ্যোক্তার’ সংখ্যাও কম নেই এ জেলায়।
প্রতিষ্ঠিত কয়েকজন নারী উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরসরি পণ্যসামগ্রী বিক্রি কম করেন নারী উদ্যোক্তারা। তারা সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে পেইজ, গ্রুপ খোলেন। সেখানে নিজের পণ্য সামগ্রী পোস্ট দিয়ে বিক্রি করে থাকেন।
শরিফা খাতুন নামে এক নারী উদ্যোক্তা বলেন, ‘কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীরা অনলাইনে পণ্য বেচাকেনা করে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পেজÑগ্রুপ খুলে নিজের পণ্যের প্রচারণা চালায়। পরে অর্ডার এলে ভোক্তার কাছে পণ্য সামগ্রী কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয়।’
নূর-ই-জান্নাত নামে আরেক উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমরা আমাদের জায়গায় থেকে সবচেয়ে ভালো জিনিসটা প্রস্তুত করে ভোক্তার হাতে দেওয়ার চেষ্টা করি। অনলাইনে ব্যবসা করার সুবাদে আমরা গোটা দেশের মানুষের কাছে এসব খাদ্য-পণ্য পাঠিয়ে থাকি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সাহিদা খাতুন জানান, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জে দিনদিন নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছে। এই বিষয়টি ইতিবাচক। নারীদের মধ্যে এই প্রতিযোগীতা থাকায় তৃণমূলে তাদের অর্থনীতির চাকা দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।’
দ্রব্যমূল্যে উর্ধ্বগতির প্রভাব ব্যবসায়
বাজারে সব ধরণের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় পড়েছে প্রভাব। তাদের প্রস্তুত করা খাদ্যদ্রব্য আর পণ্য সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় খদ্দের হারাতে হচ্ছে। ফলে তাদের বেচাকেনা কম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছেÑ চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্যোক্তারা বিভিন্ন শস্য দিয়ে বানায় বিভিন্ন খাদ্য। এসব খাদ্যের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের ছাতু, আটার নাড়ু। এছাড়া অনেকেই ওষুধি ও বিভিন্ন কাঁচা মসলা দিয়ে তেল প্রস্তুত করেন। মূলত তাদের উপরই বেশি প্রভাব পড়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে ‘রকমারি হাউজ’ নামে ফেসবুক একটি পেজ খুলে কয়েক পদের ছাতু বিক্রি করেন শারমিন নাহার নীতি। ছাতুর পুষ্টি গুণাগুণ বিবেচনায় তিনি এই ভোগ্য পণ্যটিকে ‘দেশীয় হরলিক্স’ নাম দিয়েছেন। তার ছাতুগুলোয় ব্যবহার করা হয় চাল, গম, ভুট্টা, যবসহ আরও কয়েক রকমের খাদ্যশস্য। বাজারে এসব ভোগ্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাকেও ‘দেশীয় হরলিক্স’র দাম বাড়াতে হয়েছে।
শারমিন নাহার নীতি বলেন, ‘যখন ছাতুর ব্যবসা শুরু করেছিলাম। এখকার চেয়ে তখন সবধরণের খাদ্যশস্যের দাম কম ছিল। সেই অনুযায়ী ছাতুর দাম নির্ধারণ করেছিলাম। সে সময়ে প্রতিকেজি মিক্সড ছাতুর দাম ছিল ২০০ টাকা। তিন বছরের ব্যবধানে কয়েক দফায় এই ছাতুর দাম বাড়িয়ে এখন ২৬০ টাকা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ছাতুর দামও বাড়াতে হয়েছে। কিন্তু খদ্দেররা এই দাম মানতে নারাজ। ফলে অনেকে খদ্দের ছাতু কিনছেন না। বেচাকেনা তখনকার চেয়ে এখন অনেকাংশেই কম।’
নুর নাহার জলি বিভিন্ন ওষুধি গাছের ফল আর মসলা জাতীয় দ্রব্য দিয়ে তেল বানিয়ে বিক্রি করেন। চুলে দেওয়া এসব তেল চার বছর ধরে বিক্রি করছেন তিনি। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার তার এখন বিক্রি কমেছে।
তিনি বলেন, ‘বাজারে সব ধরণের জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই চুলের তেল তৈরীতে খরচ বেড়ে যায়। যার কারণে দুইশ মিলি তেলের দাম ২৫০ টাকা থেকে ৩২০ টাকা করা হয়েছে। যারা এই তেল চুলে দিয়ে উপকার পেয়েছে তারাসহ নতুন খদ্দেররাও এই তেল নিয়ে দামাদামি করেন। ব্যবসার স্বার্থে অনেকটাই কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’
নারী উদ্যোক্তাদের চ্যালেঞ্জ
নারী উদ্যোক্তাদের মোকাবিলা করতে হয় অনেক চ্যালেঞ্জ। প্রথমত তাদের সামাল দিতে হয় পারিবারিক চাপ। এছাড়া তাদের শুনতে হয় প্রতিবেশির কটু কথাও। তবুও তারা দমে যাননা। কটু কথা শক্তিতে পরিণত করে নিজেদের অদম্য ইচ্ছায় এগিয়ে যান এসব নারী উদ্যোক্তা।
নারী উদ্যাক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উদ্যোক্তা হওয়া পুরুষদের জন্য যতটা সহজ, ততোটাই কঠিন নারীর জন্য। তাদের পোহাতে হয় অনেক ঝুট-ঝামেলা। উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করাতে প্রথমে বাঁধার মুখে পড়তে হয় পরিবারের। ‘মানুষ কি বলবে’ এমন চিন্তা থেকে পরিবারের সদস্যরা মেয়েদের অনলাইন ব্যবসায় জড়াতে দিতে চায়না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ধাইনগরের বাসিন্দা হুসনেয়ারা হ্যাভেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বুটিকস পণ্য বানিয়ে বিক্রি করেন। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যোমে জীবন শুরু করায় তিনি পেয়েছেন জয়ীতা সংবর্ধনা। তার সঙ্গে এখন কাজ করেন ১ হাজার নারী।
কথা হয় এই উদ্যোমী নারী উদ্যোক্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নারীদের উদ্যোক্তা হতে চাইলে প্রথমে সম্মুখীন হতে হয় পারিবারিক চাপের। পারিবারিক বাঁধা পেরোলেই শুনতে হয় প্রতিবেশির কটু কথা। কারণ গ্রামের মানুষরা ভাবে একজন মেয়ে কেন পণ্য বেচাকেনা করবে। মেয়েরা বিয়ে করে শুধু সংসার করবে। এছাড়া উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রয়োজন অর্থ। নারীদের এই টাকা জোগান দিতে গিয়ে পোহাতে হয় অনেক বিড়ম্বনা। নারীদের ব্যবসা বাণিজ্য করতে কেউ সহজে টাকা দিতে চায় না। কারণ অনেকেই মনে করে নারীরা ব্যবসায় পারদর্শী নয়।’
তিনি বলেন, ‘নারীরা অনেক কষ্টে জিনিসপত্র তৈরী করে। নিপুন দক্ষতায় বানানো এসব পণ্য মানুষের হাতে তুলে দিতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। নিজের বানানো জিনিসকে অন্যদের থেকে সেরা প্রমাণ করতে গেলে অনেক ভুগতে হয়। যেমনটা মানসম্মত জিনিসপত্র দাম বেশিই। এটা সাধারণত খদ্দেরা বুঝতে চায় না। তারা ভাবে বাজারে বিক্রি করা অন্য আর আট-দশটা জিনিসের মতোই এই পণ্য।’
হুসনেয়ারা বলেন, “যেসব মানুষ ‘গ্রামে আবার বুটিকস’ বলে আমাকে তাচ্ছিল্য করত। তারাই এখন আমার কাছ থেকে জিনিস কেনেন। তখন আমার কাছে অনেক ভালো লাগে। এগিয়ে যেতে হলে অনেক বাঁধা আসবে কিন্তু দমে গেলে চলবে না।”
সংগ্রামী মর্জিনা খাতুন
২২ বছর ধরে সংসারের হাল ধরেছেন সংগ্রামী মর্জিনা খাতুন। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় বিক্রি করেন কলাইয়ের রুটি। ওই এলাকায় গিয়ে ‘মর্জিনা খালা’র কথা বললে এক নামে যে কেউ চিনিয়ে দেবে তার দোকান। মর্জিনা খাতুনের দোকানের কালাইরুটির স্বাদই আলাদা! এই স্বাদ বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় লবণ, মরিচ দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি ঝালভর্তা। স্থানীয় ভাষায় এই ভর্তাকে বলে ‘মরিচের নুন’।
মর্জিনা খাতুনের দোকানে না আছে আলোর বাহার, নেই চাকচিক্য। তবে গ্রাহক আছে যথেষ্ট। আছেও বেশ সুনাম। সন্ধ্যার পর দোকানে ভিড় জমে ওঠে ঝালপ্রেমীদের। যারা খাবারে ঝাল পছন্দ করেন তাদের কাছে মর্জিনা খালার ঝালভর্তা দিয়ে কালাইরুটি সবসময়ই স্পেশাল।
সরজমিনে মর্জিনার রুটির দোকানে গিয়ে দেখা যায়Ñ তিনি একমনে রুটি বানাচ্ছিলেন। তার দম ফেলার যেন সময় নেই। নেই কোনও ক্লান্তির ছাপ। কারণ তার সংসারের বোঝা তাকেই টানতে হয়। ক্লান্ত হয়ে গেলে চলবে কি!
কালাইরুটি বিক্রি করে সংসার চালান মর্জিনা খাতুন। বুধবার রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে তোলা। প্রবা ফটো
সে সময় কথা হয় মর্জিনা খাতুনের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রায় ২২ বছর আগে স্বামী তসলিম হোসেন মারা যাওয়ার পর সংসারে দেখা দেয় আর্থিক সঙ্কট। তখন তিনিই ধরেন সংসারের হাল। বেছে নেন কালাইরুটি বানিয়ে বিক্রির কাজ।
মর্জিনা খাতুনের সংসারে দুই ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে মো. সালেক প্রতিবন্ধী। ছোট ছেলে রাজু কখনও রিকশা চালায়, কখনও বারো ভাজা, বাদাম বিক্রি করে। কিন্তু তাতে আর কত টাকাই-বা আয় হয়। দিন শেষে তাকেই নামতে হয় পথে। কথাপ্রসঙ্গে তিনি জানান, অনেক চেষ্টা করেছেন ছোট ছেলের জন্য স্থায়ী কিছু করার। কিস্তিতে টাকা তুলে ছেলেকে দিয়েছেন। কিন্তু সেই টাকা গচ্চা গেছে। ছেলে ব্যবসা দাঁড় করাতে পারেনি। এখন কালাইরুটি বিক্রি করে কিস্তির টাকা শোধ করছেন তিনি।
মর্জিনা খাতুন সংসার টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। জীবনের অনেক চরাই-উৎড়াই দেখেছেন। তবে দমে যাননি। এখন দুশ্চিন্তা একটাই- যেখানে তিনি বাস করছেন সেই জামি রেল কর্তৃপক্ষের। উঠিয়ে দিলে কোথায় যাবেন তিনি জানেন না। এখন তার চাওয়া একটি বাড়ির।
তিনি বলেন, ‘আমার একটি সরকারি বাড়ির প্রয়োজন। সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারব। তাহলে আর দুশ্চিন্তা থাকবে না।’
পরিশ্রমী নারী উদ্যোক্তা হয়
চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান ইসয়াসমিন সুলতানা রুমা বলেন, ‘যেসব নারীর পরিশ্রম করে নিজের অবস্থানকে দৃঢ়ের পাশাপাশি শত বাঁধাতেও দমে যায়না তারাই কেবল উদ্যোক্তা হতে পারে। সাধরণত নারীরা বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোক্তার খাতায় নাম লেখান। আবার অনেকেই অন্যের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।’
তিনি বলেন, ‘প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া নারীদের জন্য অনুদানের ব্যবস্থা থাকে। অনেকেই এই টাকা দিয়ে তিলে তিলে নিজের ব্যবসাকে দাঁড় করানোর জন্য চেষ্টা করেন। আমারও খোঁজ খবর রাখি। যেসব নারী উদ্যোক্তা টাকার অভাবে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করতে পারেনা। তাদেরও বিভিন্নভাবে সহায়তা করা হয়।’
নারী উদ্যোক্তারা এগিয়ে যাক। তারা সবসময় ভাল থাকুক বলেও মন্তব্য করেন ইসয়াসমিন সুলতানা।