আ ন ম আমিনুর রহমান
প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৪ ১১:৫২ এএম
আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২৪ ১৩:৪৯ পিএম
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার সাগরনাল বন বিটের পাঁকুড় গাছে নীলকান বসন্তবৌড়ি। ছবি : লেখক
বছর দুয়েক আগের কথা। সকাল আটটা বেজে দুই মিনিট অতিক্রান্ত হয়েছে। ক্যামেরা হাতে ফোল্ডিং চেয়ারে বসে আছি মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার সাগরনাল বন বিটের নাম না জানা এক পাহাড়ের ওপর। পাহাড়ের শতবর্ষী এক পাঁকুড় গাছ সবুজ-লাল ফলে ছেয়ে আছে। আর সেই ফলে সমানে ঠোঁট চালাচ্ছে ফলের মতো রঙেরই একটি ছোট্ট পাখি। দিনভর পাখিটিকে দেখলাম এই পাকুড় গাছে। একবার আসছে, ফল খেয়ে চলে যাচ্ছে। আবারও আসছে, ফল খেয়ে চলে যাচ্ছে। তবে একটি মাত্র পাখিই ওখানে ছিল না, বরং একই প্রজাতির বেশকটি পাখিই যাওয়া-আসা করছিল। পাখিটিকে প্রথম দেখেছিলাম এরও প্রায় দশ মাস আগে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে। ওকে প্রথমবার দেখার গল্পটি না বলে পারছি না।
১০ মার্চ ২০২১-এর ঘটনা। অসময়ে বৃষ্টির কারণে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের টাওয়ারের পাশের মান্দার গাছের প্রায় অর্ধেক ফুল ঝরে পড়ায় গাছে পাখি আসা কমে গেল। ফলে বৃষ্টি হওয়ার মাত্র তিন দিন পরও তেমন কোনো পাখির দেখা পেলাম না, নতুন পাখি তো দূরের কথা। দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ১১ মার্চ আবারও টাওয়ারে উঠলাম। কিছুক্ষণ পর আরও কজন পক্ষী আলোকচিত্রী এসে হাজির হলো। কিন্তু তেমন কোনো পাখির দেখা নেই। কিছু সাধারণ পাখি, যেমনÑ ভাত শালিক, কাঠ শালিক (Chestnut-tailed starling), সিপাহী বুলবুল (Red-whiskered Bulbul), কালোমাথা বুলবুল (Black-headed Bulbul), সোনাকপালি হরবোলা (Golden-fronted Leafbird), দুই প্রজাতির ফুলঝুরি ও ফিঙ্গে কুলি (Asian Drongo Cuckoo) ছাড়া অন্য কোনো পাখি মান্দার গাছে এলো না, আশেপাশের বিভিন্ন গাছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রইল।
মাঝেমধ্যে দূর আকাশে দুয়েকটা শিকারি পাখিকে উড়তে দেখা গেল। এমন সময় হঠাৎ এক্সপ্লোরার বিটুর ডাকÑ ‘আমিন ভাই, ন্যাড়া গাছে সবুজ রঙের কী পাখি এলো?’ দ্রুত ওর কাছে গেলাম। ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে মনটা খুশিতে নেচে উঠল। ‘আরে এটা তো সেই পাখি যাকে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে খুঁজছি’Ñ আমি বললাম। এক ক্লিকে চারটি ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গেই পাখিটি পাশের নাম না জানা ফুলেল গাছটিতে গিয়ে বসল। আর যায় কোথায়? একসঙ্গে যেন ১০টি ক্যামেরার শাটার ছররা গুলির মতো বেজে ওঠল। আর আমার পক্ষিতালিকায় আরেকটি নতুন পাখি যোগ হলো।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান ও সাগরনাল বনবিটের পাহাড়ে এক যুগেরও বেশি সময় খোঁজার পর আমার পক্ষীতালিকায় যোগ হওয়া নতুন পাখিটি এদেশের বিরল আবাসিক পাখি নীলকান বসন্তবৌরি। সবুজাভ বসন্তবৌরি বা নীলকর্ণ বসন্তবৌরি (পশ্চিমবঙ্গ) নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Blue-eared Barbet বা Large-billed Barbet। মেগালাইমিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Psilopogon cyanotis (সিলোপোগন সায়ানোটিস)। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাখিটির বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।
নীলকান বসন্তবৌড়ি খাটো ঘাড়, বড় মাথা ও ছোট লেজের মোটা ধরনের পাখি। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের দৈর্ঘ্য ১৬ থেকে ১৭ সেন্টিমিটার ও ওজন ৩২ থেকে ৪০ গ্রাম। দেহের পালকের রঙ সবুজ। মুখমণ্ডল, গলা ও কান-ঢাকনি নীলচে। চোখের নিচে ফ্যাকাশে কমলা পট্টি ও কান-ঢাকনির ওপর ও নিচে আরও দুটি লাল পট্টি দেখা যায়। গলা ও বুকের ওপর দিয়ে একটি কালো ফিতে চলে গেছে। ঠোঁট কালো। পা, পায়ের পাতা ও আঙুল ময়লাটে-সবুজ। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ পাখির কপাল কালো। অন্যদিকে স্ত্রীর কপাল ফ্যাকাশে কালো এবং কান-ঢাকনির ওপর ও নিচে কমলার আভা থাকে। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথা সবুজ এবং কান-ঢাকনি ও গলায় কিছুটা নীল রঙ থাকে।
এরা চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বনের পাখি। সচরাচর ঘন বনের ফলদ গাছের মগডালে বা উঁচু ডালে বসে থাকে বলে সহজে চোখে পড়ে না। দিবাচর ও বৃক্ষচারী পাখিগুলো একাকী বা জোড়ায় বিচরণ করে। এদের কখনোই মাটিতে নামতে দেখা যায় না। মূলত ফলখেকো পাখিগুলো প্রয়োজনে পোকামাকড়ও খেতে পারে। কর্কশ ও ধাতব কণ্ঠে ‘কুতুরর-কুতুরর-কুতুরর…’ শব্দে ডাকে।
এপ্রিল থেকে জুন প্রজননকাল। এ সময় এরা ঘন বনের গাছের মরা ডাল বা কাণ্ডে গর্ত খুঁড়ে বাসা তৈরি করে। স্ত্রী দুই থেকে চারটি ডিম পাড়ে, রঙ সাদা। স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে ডিমে তা দেয়। ডিম ফোটে ১৩ থেকে ১৫ দিনে। আয়ুষ্কাল ৮ থেকে ৯ বছর।