বান্দরবান প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৪ ১৮:১৪ পিএম
আপডেট : ১০ মার্চ ২০২৪ ১৯:২৪ পিএম
রেংমিটচ্যভাষীদের জন্য নবর্নিমিত প্রাথমিক বিদ্যালয় উদ্বোধন করেছে সেনাবাহিনী। ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে ম্রো জাতিগোষ্ঠীর কয়েকজন নারী। রবিবার বান্দরবানের আলিকদমের দুর্গম এলাকা ক্রাংসিপাড়ায়। প্রবা ফটো
একটি ভাষা– একটি জাতির ভাবপ্রকাশের সহজাত বাহন। সেই বাহন হয়ে থাকে মৌখিক বা লিখিত। যুগের পর যুগ ধরে তেমন একটি ভাষা– রেংমিটচ্য ছিল মৌখিক। সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ‘ম্রো’ সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল এই ভাষা ব্যবহারের আধিক্য। দিনে দিনে রেংমিটচ্য ভাষার ব্যবহার কমতে থাকে। অবশেষে এমন পর্যায়ে আসে যে পার্বত্য অঞ্চলের মাত্র ছয়জন মানুষ রয়েছেন– যারা এই ভাষাটি আঁকড়ে আছেন।
নানা সময় খবরের শিরোনাম হওয়া রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে একটা পর্যায়ে শুরু হয় নানান উদ্যোগ। এক মাস আগে প্রথম লিখিত রূপ পায় এই ভাষা। ম্রো সম্প্রদায়ের লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো রচনা করেন ‘মিটচ্য তখক’ শিরোনামে রেংমিটচ্য ভাষার প্রথম অভিধান।
সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ভাষাটি বাঁচানোর এই লড়াইয়ে এবার যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। রেংমিটচ্য ভাষা চর্চা বাড়ানোর জন্য গোটা একটি স্কুল বানিয়ে দিয়েছে সেনাবাহিনী। বান্দরবানে আলীকদমে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘ক্রাংসিপাড়া সেনা মৈত্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামের একটি স্কুল। রবিবার (১০ মার্চ) স্কুলটি আনুষ্ঠানিকভাবে পথচলা শুরু করেছে।
বেলা ১২টার দিকে সংগীত পরিবেশনের পর প্রধান অতিথি সেনাবাহিনীর বান্দরবান রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. গোলাম মহিউদ্দিন আহমেদ এই স্কুল উদ্বোধন করেন। এ সময় সেনাবাহিনীর পক্ষে স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা ও ক্রীড়াসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে স্থানীয় ক্রাংসিপাড়াবাসীদের চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনীর বান্দরবান রিজিয়নের নবনিযুক্ত কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মেহেদী হাসান, আলীকদম রিজিয়ন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল শওকাতুল মোনায়েম, আলীকদম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার তবিদুর রহমান, ক্রাংসিপাড়াবাসী ও নবনির্মিত স্কুলের শিক্ষার্থীরা।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিলুপ্তপ্রায় রেংমিটচ্য ভাষা সম্পর্কে সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। এই ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে আমরা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। বান্দরবানে শিক্ষার প্রসার, চিকিৎসা সহায়তা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন মানোন্নয়নে সেনাবাহিনী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’
ক্রাংসিপাড়া সেনা মৈত্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চিংরাও ম্রো বলেন, ‘আমাদের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে এত দিন নিজের বাড়িতে ছেলেমেয়েদের পড়িয়েছি। পাড়াবাসী ও রেংমিটচ্য ভাষাভাষীর পরিবারগুলোর স্কুল নির্মাণের ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক সংকটে তা পারিনি। সেনাবাহিনীর উদ্যোগে স্কুল নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। এখন রেংমিটচ্য ভাষা নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের শেখাতে পারব।’
রেংমিটচ্য ভাষার লিখিত রূপ প্রকাশ পায় ৩০ জানুয়ারি। সেদিন বান্দরবান শহরের শৈ শৈ ক্যাফে রেস্তোরাঁয় ঘরোয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অভিধানটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অভিধানটির প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়েছে বর্তমানে রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলতে পারা ছয়জনের ছবি। তারা হলেন- নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা চাইন প্রা মৌজার কাইংওয়াই পাড়ায় মাংপুন ম্রো, কুন রাও ম্রো, মাংওয়ই ম্রো ও মাংপুন ম্রো। এ ছাড়া মেনচিংপাড়ার থোয়াইংলক ম্রো এবং ওয়াই বটপাড়ার রেংপুন ম্রো। তাদের মধ্যে দুজন নারী ও চারজন পুরুষ।
রেংমিটচ্য ভাষার অভিধানের লেখক ইয়াংঙান ম্রো বলেন, ‘২০১৪ সালেও রেংমিটচ্য ভাষার ৩২ জন ছিলেন। ২০২৩ সালে তা কমে মাত্র ছয়জন হয়েছে। বাকিরা মারা গেছে। যারা বেঁচে আছেন তাদের সবার বয়স গড়ে ৬০ বছরের ওপরে। তারা মারা গেলে মানব সভ্যতা থেকে একটি ভাষার পরিসমাপ্তি ঘটবে।’