রেজাউল করিম, গাজীপুর
প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৪ ১৪:১৫ পিএম
আপডেট : ০৯ মার্চ ২০২৪ ১৪:৩৩ পিএম
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কারখানা বাজার এলাকায় তুরাগ নদের পাড় ও আশপাশের ৩-৪ কিলোমিটারজুড়ে অবাধে কাটা হচ্ছে ফসলি জমির মাটি। প্রবা ফটো
গাজীপুরের বিভিন্ন উপজেলায় তুরাগ নদীর তীরে চলছে ফসলি জমির মাটি কাটার ধুম। নদীর পাড়ে ফসলি জমির মাটি কাটা যেন উৎসবে পরিণত হয়েছে। এতে দিন দিন কমে যাচ্ছে কৃষিজমি। খোঁজ নিয়ে জানা গছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কারখানা বাজার এলাকায় তুরাগ নদীর পাড় ও আশপাশের ৩-৪ কিলোমিটারজুড়ে কাটা হচ্ছে ফসলি জমির মাটি। মাটি কেটে ২০-৩০ ফুট গর্ত করা হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে একেবারে নদীর তীর ঘেঁষে মাটি কাটা হয়েছে। এ ছাড়া গাজীপুর সদর, কালিয়াকৈর, কালীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে চলছে মাটি কাটা।
সম্প্রতি সরেজমিন কারখানা বাজার এলাকায় দেখা যায়, মীরেরগাঁও এলাকা দিয়ে মাটিভর্তি ড্রাম ট্রাক সারিবদ্ধভাবে চলছে। সামনে যতই এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে ট্রাকের সংখ্যা বাড়ছে। কারখানা বাজার ও বিপ্লবর্থা গ্রামের বিভিন্ন স্থানে পার্ক করে রাখা হয়েছে ট্রাক। তুরাগ নদীর দিকে তাকালেই দেখা যায় কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কাটা হচ্ছে মাটি। ৩-৪টি এক্সকাভেটর (খনন যন্ত্র) দিয়ে মাটি কেটে ডাম্প ট্রাকে ভরা হচ্ছে। এসব ট্রাক চলাচলের জন্য ফসলি জমি ও তুরাগ নদের মধ্যে মাটি ফেলে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।
কৃষিবিদদের মতে, জমির উপরিভাগের চার থেকে ছয় ইঞ্চি (টপ সয়েল) গভীরের মাটিতেই মূল পুষ্টিগুণ থাকে। মূলত মাটির এই স্তরে ফসল উৎপাদিত হয়। মাটির এই স্তর কেটে নেওয়ায় জমির উর্বরাশক্তি নষ্ট হয়। এজন্য অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করেও কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যায় না। তা ছাড়া কৃষিজমির ওপরের এ টপ সয়েল হারিয়ে ফেললে তা স্বাভাবিক হতে প্রায় ১০-১২ বছর লাগে।
স্থানীয়রা জানান, ২-৩ বছর ধরে এই ব্যবসায়ীরা কৃষকদের নগদ টাকার প্রলোভন দেখিয়ে মাটি কিনে নিচ্ছে। অনেকে আবার অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিক্রি করছে। কারণ আশপাশের জমির মাটি বিক্রি করা হচ্ছে। এতে চাষবাসের সমতা হারাচ্ছে। জমি ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া মাটি ব্যবসায়ীরা অনেক প্রভাবশালী। ১ বিঘা জমির ১০ ফিট গভীর মাটি কাটার বিনিময়ে ৪ লাখ টাকা পাচ্ছে কৃষক। তবে প্রকৃত অর্থে গভীরতা আরও বেশি হচ্ছে। মাটি ব্যবসায়ীরা এক ট্রাক মাটি বিক্রি করে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকায়। এসব মাটি আশপাশের নিচু জমি ভরাট করা ছাড়াও ইটভাটার কাজে লাগানো হয়। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়েই দিনের পর দিন চলছে মাটি কাটা। মাটি ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী হওয়ায় কিছু বলতেও সাহস পাচ্ছে না স্থানীয়রা।
স্থানীয় বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘মাটি সবাই বিক্রি করছে, কেউ লোভে, কেউবা চাপে। আমিও গতবার বিক্রি করেছি, সেখানে এখন মাছ চাষ করছি। তবে সত্যি বলতে মাটি কাটার ফলে এসব জমির মূল্য কমে যাচ্ছে।’
বিপ্লবর্থা গ্রামের বাসিন্দা ফারুক মিয়া বলেন, ‘কার্তিক মাস থেকে মাটি কাটা শুরু হয়। আমরা ১ পাকি (বিঘা) জমি ৪ লাখ ২০ টাকায় বিক্রি করি। পরে তারা এসব মাটি প্রতি ট্রাক ২ হাজার ৫ টাকায় বিক্রি করে। এলাকার অনেকেই মাটির ব্যবসা করেন। এর মধ্যে মনির, কবির, ফারুক মিয়া, সাধন চন্দ্র রায়সহ অনেকেই।
অভিযুক্ত সাধন চন্দ্র রায় গাজীপুর মহানগরীর আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিউজ করলে করেন, ভালো করে লেখেন। মাটি কাটতে গেলেই সবাই বাধা দিচ্ছে। এখন আর মাটি কাটছি না। অনেকেই কাটছে, তাদের নাম বলব না। আমি এখন ভেকু ভাড়া দিয়েছি। মাটি কাটার নিষেধ আছে, এটা ঠিক আছে। কিন্তু দেশের কয়জন সৎ, সবাই তো আইন ভঙ্গ করে।’
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ), ২০১৩ অনুযায়ী, কৃষিজমির মাটি কেটে শ্রেণি পরিবর্তন করা নিষিদ্ধ। এসব কাজে জড়িত ব্যক্তিদের দুই লাখ টাকা জরিমানা ও দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। এ আইন প্রয়োগ করবে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন।
গাজীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফয়সাল হক বলেন, ‘নদীর তীরবর্তী এলাকা থেকে মাটি কেটে নেওয়ার বিষয়টি জানি। অনেকবার সেখানে অভিযান চালিয়েও কাউকে ধরতে পারিনি। অভিযানে গেলেই কীভাবে যেন তারা টের পেয়ে পালিয়ে যায়। সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করা হবে।