সুফল চাকমা, বান্দরবান
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৪ ১০:৪২ এএম
আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২৪ ১০:৪৬ এএম
গুংগুরু পাড়া উপজাতীয় মহিলা উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করে ছোট বোনকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন তাঁতশ্রমিক খাইসিং নু খেয়াং। প্রবা ফটো
পাহাড়িদের মধ্যে অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে তলানিতে রয়েছে খেয়াং সম্প্রদায়। বান্দরবান ও রাঙামাটি- দুই জেলায় তাদের জনসংখ্যা মাত্র পাঁচ হাজার। তাদের মধ্যে নারীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। একদিকে অর্থনৈতিক সচ্ছলতার জন্য লড়াই, অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় টিকে থাকার লড়াই। পিছিয়ে পড়া এই নারীদের আত্মনির্ভরশীল করতে কাজ করে যাচ্ছে গুংগুরু পাড়া উপজাতীয় মহিলা উন্নয়ন সংস্থা।
বান্দরবান শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে খেয়াং গ্রাম গুংগুরু পাড়া। গত বুধবার সরেজমিন দেখা যায়, সংস্থার অফিসে কেউ সুতায় মাড় দিয়ে রোদে শুকাতে দিচ্ছেন, কেউ তাঁত বুনছেন, কেউ সুতা নলিতে ভরছেন, কেউ ববিন ফ্লেইম করছেন, কেউ ড্রাম টানা করছেন, কেউ ছানা গাঁথা করছেন, কেউ কাপড় সেলাই করছেন। দৈনিক একেকজন নারী সেখানে ৩০০ থেকে সাড়ে ৪০০ টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকেন।
নতুন তাঁতশ্রমিক আপুমে খেয়াং মাসিক ৪ হাজার টাকায় কাজ শুরু করেন। তা দিয়েই পরিবারে সচ্ছলতা না এলেও মোটামুটি আগের চেয়ে ভালো আছেন বলে তিনি জানান। তাঁতশিল্পী বিজিম খেয়াং কাজ করছেন প্রায় এক বছর হলো। প্রতিদিন ৩ ঘণ্টা কাজ করে মাসে ৮-৯ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন তিনি।
তাঁতশ্রমিক খাইসিং নু খেয়াংয়ের বাবা চার বছর আগে মারা গেছেন। তারা দুই ভাই ও তিন বোন। তাদের মধ্যে খাইসিং নু দ্বিতীয়। দুই বোন কলেজে পড়ে, এক ভাই ক্লাস নাইনে পড়ে। খাইসিং ও তার মা দুজন মিলে সংসার টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। খাইসিং বলেন, প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত কাজ করেন তিনি। তার মাসিক বেতন ৪ হাজার টাকা। বিকালে কাজ করেন না। তখন বাড়িতে অন্যান্য কাজ করেন। সংস্থা শুধু কাজের ব্যবস্থাই করেনি, সদস্যদের অন্যান্য সুবিধাও দিয়ে থাকে। থুইজো খেয়াং নামে একজন সদস্য বলেন, সংস্থা থেকে তাকে ১ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন ঘর করে দেওয়া হয়েছে। এতে তিনি খুশি।
সংস্থার সদস্যরা মোমবাতিও তৈরি করেন। সংস্থার সদস্যদের নিরাপদ পানির জন্য পাঁচটি টিউবওয়েল দেওয়া হয়েছে। আদা ও হলুদ চাষ করার জন্য কৃষকদের বীজ দেওয়া হয়। সমিতির একটি মাহিন্দ্র পিকআপ আছে, যা সদস্যদের বিভিন্ন কাজে লাগে।
সংস্থার সভানেত্রী উম্রাচিং খেয়াং বলেন, প্রত্যেক সদস্যের মাসে সঞ্চয় ১০০ টাকা ও বিবিধ খরচ ২০ টাকা দিতে হয়। সদস্যদের কৃষিকাজে ছয় মাস মেয়াদে ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা লাভের বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। সদস্যরা সমিতির বিভিন্ন কাজ করে পরিশোধ করেন। সমিতির পক্ষে সুদমুক্ত টাকায় গরু দেওয়া হয়। পরবর্তীতে কৃষক গরু বিক্রি করে মূল টাকা পরিশোধ করেন। যাদের ঘর নেই, সংস্থা তাদের নতুন ঘর করে দেয়। এ পর্যন্ত ১৫ জন সদস্যকে নতুন ঘর করে দেওয়া হয়েছে।
১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ২০০০ সালের ২ এপ্রিল মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন পায় সংস্থাটি। মাঝখানে কিছুদিন কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ২০১০ থেকে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছে। সংস্থা পরিচালনার জন্য ১১ সদস্যবিশিষ্ট কার্যকরী কমিটি রয়েছে।
সভানেত্রী উম্রাচিং খেয়াং বলেন, খেয়াং অধ্যুষিত এলাকায় তারা দুটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে পরিচালনা করছেন। তিনি বলেন, বান্দরবান জেলায় ১১টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাস। তার মধ্যে খেয়াং জনগোষ্ঠী সংখ্যায় খুব কম। তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য রয়েছে। খেয়াং জনগোষ্ঠীর নারীরা অন্য নারীদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। পিছিয়ে পড়াদের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে গুংগুরু পাড়া উপজাতীয় মহিলা উন্নয়ন সংস্থা।
নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন নারী সংগঠনকে আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। গুংগুরু পাড়া উপজাতীয় মহিলা উন্নয়ন সংস্থাও আর্থিক অনুদান পেয়েছে বলে জানান সভানেত্রী উম্রাচিং খেয়াং। তিনি বলেন, তাদের সংস্থায় বর্তমানে নিয়মিত ও অনিয়মিত মিলে ৮০ জন সদস্য আছে। চলতি বছর থেকে সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হবে। খেয়াং সম্প্রদায়ের নারী হলে ভোটার আইডি কার্ড ও ছবি দিয়ে সদস্য হওয়া যায় বলে তিনি জানান।