চৌধুরী মাসুদ আলী ফরহাদ, হবিগঞ্জ
প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৪ ১২:৩২ পিএম
খোয়াই নদের প্রতিরক্ষার বাঁধ কেটে সড়ক নির্মাণ করায় মূল বাঁধের হবিগঞ্জ থেকে চুনারঘাটের বাল্লা পর্যন্ত বিভিন্ন অংশ খুবেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। প্রবা ফটো
বেপরোয়া হয়ে উঠেছে হবিগঞ্জের বালু ব্যবসায়ীরা। খোয়াই নদ থেকে ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু ও এক্সকাভেটর (ভেকু মেশিন) দিয়ে মাটি উত্তোলনের পাশাপাশি বালু বিক্রির জন্য পরিবহনের সুবিধা পেতে খোয়াই নদের প্রতিরক্ষা বাঁধ কেটে সড়ক নির্মাণ করায় মূল বাঁধের হবিগঞ্জ থেকে চুনারুঘাটের বাল্লা পর্যন্ত বিভিন্ন অংশ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আসছে বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঢলের পানি খোয়াই নদের বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইলে যেকোনো সময় বাঁধ ভেঙে হবিগঞ্জ সদর, শায়েস্তাগঞ্জ ও চুনারুঘাট উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নসহ পৌর এলাকা তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। এ ছাড়া খোয়াই নদের চর কেটে মাটি বিক্রির মহোৎসবে মেতে উঠেছেন ইজারাদাররা।
হবিগঞ্জ জেলা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ৯৩ কিলোমিটার খোয়াই নদ। এটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আঠারোমুড়া থেকে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বাল্লা নামক স্থান দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। স্থানীয় প্রশাসন মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বালু তোলার যন্ত্রপাতি জব্দ করলেও থেমে নেই তাদের কার্যক্রম।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জেলায় আটটি সাধারণ বালুমহাল রয়েছে। এর মধ্যে চুনারুঘাটের খোয়াই নদের রাজার বাজার মৌজার সাধারণ বালুর অংশ জেলা প্রশাসন থেকে সাড়ে সাত কোটি টাকায় ইজারা নেন চুনারুঘাটের সাটিয়াজুড়ি ইউনিয়নের সুন্দরপুর গ্রামের সেলিম আহমেদ। আইন ভাঙার কারণে তার বিরুদ্ধে পরিবেশ আদালতের মামলাসহ সাংবাদিকদের মারধর মামলায় জামিনে আছেন তিনি। এ ছাড়া বালু মজুদের জন্য স্থানীয় নিরীহ মানুষের জমি জবরদখলেরও অভিযোগ ছিল। নদীর পাকুরিয়া মৌজার অংশ ৬ কোটি ২৫ লাখ টাকায় ইজারা নেন একই উপজেলার দেওরগাছ ইউনিয়নের আমতলী গ্রামের শফিক মিয়া। হবিগঞ্জ সদর ও শায়েস্তাগঞ্জ মৌজার অংশ ২ কোটি ৬১ লাখ টাকায় ইজারা নেন একই উপজেলার ওবাহাটা ইউনিয়নের উলুকান্দি গ্রামের ফারুক মিয়া নামে আরেক ব্যক্তি।
জানা গেছে, বাংলা সাল ১৪২৯-এর চৈত্র মাসে এসব বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়। এরপর বালু কাটা শুরুর কিছু দিন পরই বালু পরিবহনের জন্য খোয়াই নদের প্রতিরক্ষা বাঁধ কেটে রাস্তা করা হয়। এতে বাঁধটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
চুনারুঘাটের আশ্রবপুর গ্রামের খোরশেদ আলম, মো. মুর্শেদ আলম, রাজার বাজার এলাকার মহিউদ্দিন আহমেদ, আব্দুল কদ্দুছ খানাসহ এলাকাবাসীর অভিযোগ, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক ও প্রভাবশালীদের সমন্বয়ে গঠিত এই বালু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কিছু বললে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়।
যদিও আইন অনুযায়ী বাঁধের ১০০ ফুট দূর থেকে (রেম তৈরি করে) রাস্তা তৈরি করে বালু তোলার কথা। কিন্তু অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে নদীর বাঁধের পাশ থেকে বালুবোঝাই পরিবহন চলাচলের জন্য বাঁধ কেটে রাস্তা তৈরি করেন ইজারাদাররা। জেলা প্রশাসনের ইজারা দেওয়া বালুমহাল ছাড়াও ইজারা বহির্ভূত জায়গা থেকে প্রতিদিন বালু তুলছে চক্রটি। এ ছাড়া কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে হবিগঞ্জ সদর, শায়েস্তাগঞ্জ ও চুনারুঘাট উপজেলার বিভিন্ন স্থানে খোয়াই নদের চর কেটে মাটি বিক্রি করা হচ্ছে। ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে শ্যালো মেশিন দিয়ে দিনরাত বালু উত্তোলন করছে চক্রটি। আর এসব বালু পরিবহনের জন্য দানব আকৃতির ট্রাক্টর চলছে গ্রামীণ কাচা সড়কে। এতে সড়ক ও বিভিন্ন সেতু ভাঙার পাশাপাশি নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে স্থানীয়রা। আবার এসব বালু চুনারুঘাট-বাল্লা সড়কসহ বিভিন্ন সড়কের পাশে রেখে লোড-আনলোড করার কারণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে।
অসাধু বালু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ঘনঘন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনের প্রতি দাবি জানিয়েছন ভুক্তভোগীরা। শায়েস্তাগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মো. শামিমুর রহমান বলেন, প্রতিরক্ষা বাঁধটি মেরামতের জন্য হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ বরাবরে লিখিত আবেদন করেছি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দেলন (বাপা) হবিগঞ্জ কমিটির সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, নদী থেকে অনিয়ন্ত্রিত অপরিকল্পিত বালু ও মাটি উত্তোলনের ফলে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। দায়িত্বশীলদের উদাসীনতার কারণেই এমনটি হচ্ছে। এতে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের পাশাপাশি পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি হবে।
অভিযোগের বিষয়ে ইজারাদার সেলিম আহমেদ, শফিক মিয়া ও ফারুক বলেন, সরকারের নিয়মনীতি মেনেই তারা মাটি ও বালু উত্তোলন করছেন।
তবে ইজারাদাররা বালু ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ অনুসরণ না করে ইজারার নিয়মনীতি ও শর্ত ভঙ্গ করে তাদের লোকজন দিয়ে বালু ও মাটি উত্তোলন করে যাচ্ছেন। ফলে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতিসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার বাঁধ ও বাড়িঘর হুমকির মুখে পড়েছে। নদীর বাঁধ কেটে বালু তোলা এবং বাঁধের ওপর দিয়ে ট্রাক, ট্রাক্টর দিয়ে মাটি পরিবহন করায় প্রতিরক্ষা বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে।
হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ বলেন, ইজারাদাররা বালুর গাড়ির জন্য উচু বাঁধ কেটে ফেলে, যেটি আইন-বহির্ভূত। এর সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রক্রিয়াধীন।
নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ কাটার মতো ঘটনা ঘটলেও এ বিষয়ে নির্বিকার স্থানীয় প্রশাসন। প্রকাশ্যে অবৈধভাবে এসব চর কেটে মাটি বিক্রি ও ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তোলা হলেও অজ্ঞাত কারণে প্রশাসন থেকে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাহিদ ভূঞা বলেন, ‘বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নীলিমা রায়হানা বলেন, বাঁধ কাটা গুরুতর অপরাধ। দ্রুত পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে যারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তোলা বন্ধে অভিযান অব্যাহত আছে।