জাতীয় পরিচয়পত্র
শফিকুল ভূঁইয়া, সরিষাবাড়ী (জামালপুর)
প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৪ ০৯:৩৮ এএম
আপডেট : ০৬ মার্চ ২০২৪ ০৯:৪২ এএম
জামালপুরের সরিষাবাড়ীর হিরণ্যবাড়ী গ্রামের একই বাড়ির সুবিধাবঞ্চিত তিন নারী মোছাম্মাৎ আনজুয়ারা, মোছাম্মাৎ মরিয়ম বেগম ও মোছাম্মাৎ জাহানারা। প্রবা ফটো
কালজয়ী সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবিত ও মৃত’ শীর্ষক গল্পের সঙ্গে কমবেশি সকলেই পরিচিত। গল্পটির অবিস্মরণীয় শেষ বাক্য হলো- ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই’। অবস্থা এমন যে, রবীন্দ্রনাথের গল্পের এই কাদম্বিনীর মতো জামালপুরের সরিষাবাড়ীর তিন নারীকেও বোধকরি মরে গিয়েই প্রমাণ করতে হবে, তারা জীবিত! কারণ জীবিত থাকলেও ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে গিয়ে তাদের ‘মৃত’ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে তাদের। ছেলেদের স্কুলে ভর্তি করাতে পারছেন না তারা। পারছেন না ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্রঋণ নিতে। বঞ্চিত ১০ টাকা কেজি দরের চালসহ বয়স্ক ও বিধবা ভাতা থেকে। ডিজিটাল মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধাও ব্যবহার করতে পারছেন না তারা।
এই তুঘলকি কাণ্ড ঘটেছে জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার মহাদান ইউনিয়নের হিরণ্যবাড়ী গ্রামে। অভিযোগ উঠেছে, এই তিন নারীকে ‘মৃত’ দেখিয়ে তাদের সরকারি বিধবা ভাতাসহ বিভিন্ন কার্ড অন্য কারও কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের এই মারাত্মক তথ্যগত ত্রুটি সংশোধনেও গড়িমসি করা হচ্ছে। কিন্তু তারা অভিমানী কাদম্বিনীর মতো মরে গিয়ে নয়, বেঁচে থেকেই নিজেদের জীবিত প্রমাণ করতে চান।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাচন অফিসে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, সেখানে সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী মোছা. মরিয়ম বেগম ২০১৬ সালের ১৭ জানুয়ারি মারা গেছেন। মোছা. জাহানারা মারা গেছেন ২০১৭ সালের ১৬ জুন। আর মোছা. আনজুয়ারার মৃত্যু ঘটেছে ২০১৮ সালের ১০ আগস্ট। জাতীয় পরিচয়পত্র হালনাগাদের সময় এ তিন জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন শফিকুল ইসলাম (ভোলা)। তিনি স্থানীয় মহাদান ইউনিয়নের শেখ খলিলুর রহমান ভোকেশনাল স্কুলের শিক্ষক।
যা বলছেন ভুক্তভোগী তিন নারী
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে প্রতিদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে কথা হয় হিরণ্যবাড়ী গ্রামের একই বাড়ির সুবিধাবঞ্চিত তিন নারী মোছাম্মাৎ আনজুয়ারা, মোছাম্মাৎ মরিয়ম বেগম ও মোছাম্মাৎ জাহানারার। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তথ্য হালনাগাদ করতে গিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রে তাদের ‘মৃত’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই মারাত্মক ‘ভুল’ কিংবা ‘পরিকল্পিত ভুলের’ কারণে তারা সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ছেলেদের স্কুলে ভর্তি করা, উপবৃত্তি সুবিধা, ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্রঋণ নেওয়া, ডিজিটাল মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা, বয়স্ক ও বিধবা ভাতা, বিজিডি চাল, টিসিবি সুবিধা, ভোটাধিকারসহ বিভিন্ন সরকারি সুবিধা থেকে এখন তারা পুরোপুরি বঞ্চিত।
মোছা. আনজুয়ারা বলেন, ‘যেকোনো সরকারি কাজেই এখন এনআইডি কার্ড লাগে। কিন্তু আমার আইডি কার্ড দিয়ে কোনো কাজ করা যায় না। যেখানেই যাই, বলা হয়- আমি নাকি মারা গেছি। আমার সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে সমস্যা হচ্ছে। আমার মেয়ে কলেজ থেকে উপবৃত্তি সুবিধা পাচ্ছে না। ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারছি না।’
আনজুয়ারার বড় ভাইয়ের স্ত্রী মোছা. মরিয়ম বলেন, ‘আমার স্বামী মারা গেছেন। তারপর আমি অনেক দিন বিধবা ভাতাও তুলেছি। কিন্তু আমাকে মৃত বানিয়ে শূন্য কার্ডটা নাকি নতুন একজনকে দেওয়া হয়েছে। আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। এদিকে কার্ড না থাকায় বিধবা ভাতাও তুলতে পারছি না। নির্বাচনেও আমি ভোট দিতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘আমি কয়েকবার নির্বাচন অফিসে গিয়েছি। তারা কার্ড ঠিক করে দেয়নি। ঠিক করে দেওয়ার কথা বলে শফিকুল ইসলাম ভোলা আমার কাছ থেকে টাকাও নিয়েছে। কিন্তু কাজ করেনি।’
একই বাড়ির ভুক্তভোগী নারী মোছা. জাহানারা বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর আমি বিধবা ভাতার জন্য আবেদন করে জানতে পারি, আমি নাকি মৃত! এ জন্য আমাকে কোনো কার্ড দেওয়া হয় নাই। আমি কোনো সরকারি সুবিধাও নিতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক করার জন্য আমিও শফিকুল ইসলাম ভোলাকে টাকা দিয়েছি। আজ না কাল, না পরশু, আরেক দিন- এইসব বলে বলে দুই বছরেও তিনি আমার আইডি কার্ড ঠিক করে দেন নাই।’
অবশ্য এ ব্যাপারে তথ্যসংগ্রহকারী শফিকুল ইসলাম (ভোলা) বলেন, ‘এটা আমারই ভুল। আমি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের আইডি কার্ড ঠিক করে দেব।’ তবে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমি তাদের কাছ থেকে কোনো টাকা নিই নাই।’
ভুক্তভোগী তিন নারী জানান, তাদের সবচেয়ে বড় সংকট হয়েছিল করোনা মহামারির সময়। ভয়ানক সেই সংকটে তারা কোনো সরকারি সুযোগসুবিধাই নিতে পারেননি। আইডি কার্ড না থাকায় করোনা টিকা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছিলেন তারা। পরে নতুন জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি করে তারা টিকা নিয়েছেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ‘একই পরিবারের তিনজনকে মৃত বানিয়ে ফেলাটা আসলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঘটনা। ভুলে হয়ে গেছে বলে এটা এড়িয়ে যাওয়া যায় না।’
স্থানীয় এক মাদ্রাসার শিক্ষক নূরুল ইসলাম মাস্টার বলেন, ‘যারা এই তালিকা তৈরি করেছেন, তাদের গাফিলতির জন্যই এরকম বিড়ম্বনা তৈরি হয়েছে।’
জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্য
এ ব্যাপারে সাবেক ইউপি সদস্য আলতাব হোসেন বলেন, ‘এই নারীদের মৃত দেখিয়ে তাদের সরকারি বিধবা ভাতাসহ বিভিন্ন কার্ড অন্যখানে বিক্রি করা হয়েছে। এ কারণে তারা এখন বেঁচে থেকেও মৃত।
বর্তমান ইউপি সদস্য নূর ইসলাম বলেন, ‘এ ঘটনার সময় আমি মেম্বার ছিলাম না। তবে এই অনিয়মে সাবেক এক ইউপি সদস্য আর তথ্য সংগ্রহকারী- এই দুজন যুক্ত।’
বিধবা কার্ডের অনিয়ম নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ.কে.এম আনিছুর রহমান জুয়েলের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এগুলো মিথ্যা কথা।’
জিজ্ঞাসার একপর্যায়ে তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘আপনি এত পেঁচাইতাছেন ক্যা? শোনেন, অতিরিক্ত সবকিছুই কিন্তু খারাপ! আপনি সাংবাদিকতা করেন ঠিক আছে। কিন্তু এত বাড়াবাড়ি করবেন না।’
বিধবা কার্ড প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শারমিন আক্তার বলেন, ভুক্তভোগীরা অফিসে এসে আবেদন করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাচন অফিসার সাখাওয়াৎ হোসেন বলেন, ‘তারা অফিসে এলে তাদের আইডি কার্ডের বিষয়টি সমাধান করে দেওয়া হবে। যাতে তারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন।’
তথ্য সংগ্রহকারী শিক্ষক শফিকুল ইসলামের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি তাকে আমার স্টাফদের মাধ্যমে আসতে বলেছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’