কাওছার আহমদ, সিলেট
প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৪ ১৩:৫৪ পিএম
আপডেট : ০৫ মার্চ ২০২৪ ১৫:২০ পিএম
সিলেট সিটি করপোরেশন। ছবি: সংগৃহীত
সিলেটে আগুনের ঝুঁকিতে থাকা ভবনের হালনাগাদ তালিকা নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে। অচিরেই শুরু হবে জানালেও কাজ এখনও শুরুই হয়নি। এর আগে বিভিন্ন সময়ে নগরীর বিভিন্ন বিপণিবিতান বা বাসাবাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের পর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরিতে তৎপরতা শুরু হলেও পরে থেমে যায়। সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) অনেক বছর আগে কিছু দায়সারা তালিকা করলেও নেয়নি কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
একাধিক সূত্র জানায়, সিলেট নগরীর অধিকাংশ বাসাবাড়ি, বিপণিবিতান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থা নেই। অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত এসব স্থাপনায় অগ্নিপ্রতিরোধে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা নেই। অনেক মার্কেটে নেই পার্কিং ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। এছাড়া বহুতল অনেক ভবনের মধ্যে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, রেস্তোরাঁ, শপিং মল ও আবাসিক হোটেল। এসব ভবনের জরুরি বহির্গমনের রাস্তা থাকলেও সেগুলো সবসময় বন্ধ থাকে। একমাত্র লিফট দিয়ে চলাচল করে থাকেন এসব ভবনের লোকজন। কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে, লিফট বন্ধ হয়ে গেলে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে এসব ভবনের বাসিন্দাদের।
সিলেটকে একসময় পুকুর ও দিঘির নগরী বলা হতো। কিন্তু এখন অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে পুকুর ও দিঘি নেই বললেই চলে। হাতে গোনা কয়েকটা ছাড়া সব পুকুর ও দিঘি ভরাট করা হয়েছে। এ অবস্থায় বড় ধরনের কোনো অগ্নিকাণ্ড ঘটলে সুরমা নদীর পানি ছাড়া পর্যাপ্ত কোনো ব্যবস্থা নেই। শুকনো মৌসুমে সুরমার পানিও হাঁটুর নিচে নামে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সিলেট কার্যালয় সূত্র জানায়, অগ্নিকাণ্ডের সময় তাদের মাত্র পাঁচতলা পর্যন্ত উদ্ধারকাজের সামর্থ্য রয়েছে। আর এর জন্য আছে মাত্র দুটি যান্ত্রিক মই (টিটিএল)। এর চেয়ে উচুঁ ভবনের জন্য কোনো যান্ত্রিক ব্যবস্থা নেই। এছাড়া নগরীর অধিকাংশ রাস্তা বা গলি টিটিএল চলাচলের অনুপযোগী এবং বিভিন্ন রাস্তায় ঝুলে থাকা ‘বৈদ্যুতিক তার’ বড় ধরনের বাধা হয়ে থাকে।
নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবন
২০১৯ সালে সার্ভে করে সিলেট নগরীতে ২৪টি ভবনকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক), যার মধ্যে সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন ভবনও রয়েছে। সিসিক সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে নগরীর ২৪টি বহুতল ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ভবনগুলোর মধ্যে রয়েছে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের উত্তর পাশের কালেক্টরেট ভবন-৩, জেলরোডের সমবায় ব্যাংক ভবন, একই এলাকায় মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার সাবেক কার্যালয় ভবন, সুরমা মার্কেট, বন্দরবাজারের সিটি সুপার মার্কেট, জিন্দাবাজারের মিতালী ম্যানশন, দরগাগেইটের হোটেল আজমীর, বন্দরবাজারের মধুবন সুপার মার্কেট, টিলাগড় কালাশীলের মান্নান ভিউ।
এছাড়া নগরের শেখঘাট এলাকায় শুভেচ্ছা-২২৬ নম্বর ভবন, যতরপুরের নবপুষ্প ২৬/এ বাসা, চৌকিদেখির ৫১/৩ সরকার ভবন, জিন্দাবাজারের রাজাম্যানশন, পুরান লেনের ৪/এ কিবরিয়া লজ, খারপাড়ার মিতালী-৭৪, মির্জাজাঙ্গাল মেঘনা এ-৩৯/২, পাঠানটুলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর বাগবাড়ির একতা ৩৭৭/৭ ওয়ারিছ মঞ্জিল, একই এলাকার একতা ৩৭৭/৮ হোসেইন মঞ্জিল, একতা-৩৭৭/৯ শাহনাজ রিয়াজ ভিলা, বনকলাপাড়া নূরানি-১৪, ধোপাদিঘির দক্ষিণ পাড়ের পৌরবিপণি মার্কেট, ধোপাদিঘির পাড়ের পৌর শপিং সেন্টার ও পূর্ব পীরমহল্লার ৬২/বি প্রভাতী শ্রীধরা হাউস। এর মধ্যে পুরান লেনের ৪/এ কিবরিয়া লজটি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়ে মেরামত করা হয়েছে। এছাড়া কালেক্টরেট ভবন-৩, বনকলাপাড়া নূরানি-১৪, ধোপাদিঘির পাড়স্থ পৌরবিপণি ও পৌর শপিং সেন্টার অপসারণ করা হয়েছে বলে সিসিক জানিয়েছে।
তালিকা হলেও ব্যবস্থা নেই
সাত বছর আগেই ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছিল সিসিক। তবে অজ্ঞাত কারণে সে উদ্যোগ থেমে যায়। জানা যায়, ২০১৬ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে পরিচালিত জরিপের মাধ্যমে ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে নগরের ৩২টি ভবনকে চিহ্নিত করে সিসিক। এ তালিকায় ছিল অনেক বাসাবাড়ি, বিপণিবিতান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা।
সে সময় ওই ভবনগুলো অতি দ্রুত ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয় সিলেট সিটি করপোরেশন। মালিকপক্ষ না ভাঙলে নিজেরাই ভবনগুলো ভেঙে দেবে বলে জানায় সিসিক। এর মধ্যে দুয়েকটি ভবন ভাঙার কাজ শুরুও করে সিসিক। তবে আটকে যায় সেই কাজ। পরে সিসিকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভাঙা নয়, মেরামত করা হবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো। কিন্তু সাত বছরেও সেই মেরামত হয়নি। সে সময় সিটি করপোরেশন জানিয়েছিল, কেবল ৩২টি নয়, নগরীতে আরও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সেসব তালিকা করে নোটিস দেওয়া হবে। এর মধ্যে শপিং মল, অ্যাপার্টমেন্ট, হোটেল রয়েছে। এসব বহুতল ভবনের বেশিরভাগেরই অনুমোদন নেই।
সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, ছয়তলার চেয়ে বেশি উঁচু ভবনের অনুমোদন আমরা সরাসরি দিই না। ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নিয়ে এলে অনুমোদন দেওয়া হয়ে থাকে। অগ্নিকাণ্ডে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা আগে সেভাবে করা হয়নি। তবে এক সপ্তাহ পরে জানতে পারবেন।
এ তো গেল সিসিক। আর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সিলেটের কাছে কোনো তালিকাই নেই। তবে আশার কথা শুনিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সিলেটের উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জামানও। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আজকালের মধ্যে মহাপরিচালকের কার্যালয় থেকে চিঠি আসবে। এরপর আমরা সরেজমিন পরিদর্শন করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করব। আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যে অধিক ও কম ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের একটি তালিকা তৈরি করা সম্ভব হবে। এরপর মিডিয়াকে এ ব্যাপারে তথ্য দেওয়া যাবে।’