রাজু আহমেদ, রাজশাহী
প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৪ ১১:০২ এএম
আপডেট : ০৫ মার্চ ২০২৪ ১৩:২৪ পিএম
সোমবার রাজশাহী নগরীর সাহেব বাজার এলাকা থেকে তোলা। প্রবা ফটো
রাজশাহীতে ঘুরতে এসেছেন ইংল্যান্ড-ফেরত সালাউদ্দিন মাসুদ। এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার কারণে মহানগরের কোনো আবাসিক হোটেল ফাঁকা নেই। রাতযাপনের জন্য তাই গত রবিবার তিনি নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকার সাধারণ মানের বনতলা আবাসিক হোটেলে উঠেছিলেন।
সোমবার (৪ মার্চ) ভোরে তিনি পরিচ্ছন্ন রাজশাহী নগরী ঘুরে দেখবেন বলে হোটেল থেকে বের হতে যান। কিন্তু হোটেলের দরজায় তালা ঝুলছে বলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ডাকতে থাকেন। কিন্তু এভাবে আধা ঘণ্টা ডাকাডাকির পরও কেউ সাড়া দেয়নি। এতে রীতিমতো ঘাবড়ে যান তিনি। পরে দরজা খোলা হলে তিনি এমন অব্যবস্থাপনার কারণে ওই হোটেলই ছেড়ে দেন। দুপুরে তিনি রাজশাহী বিভাগের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালকের সঙ্গে দেখা করেন। তাদের কাছে তিনি অভিযোগ করেন, ওই ভবনটিতে আবাসিক হোটেল করার মতো পরিবেশ নেই। ঝুঁকিপূর্ণ ওই ভবনে যেকোনো সময় অগ্নিকাণ্ডসহ যেকোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। হোটেলের একই ভবনে রয়েছে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। পরে সন্ধ্যা ৬টার ফ্লাইটে তিনি রাজশাহী ত্যাগ করেন।
প্রতিদিনের বাংলাদেশকে সালাউদ্দিন মাসুদ জানান, তিনি ইংল্যান্ডে চাকরি করতেন। পেশায় বিল্ডিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (বিএমএস) প্রকৌশলী। সম্প্রতি তিনি কর্মজীবন শেষে অবসরে গেছেন। রাজশাহী শহরের প্রশংসা শুনে তিনি এখানে বসবাসের জন্য পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলেন। অ্যাপার্টমেন্ট কিনবেন বলেও ঠিক করেছিলেন। তবে প্রথম দিনেই এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে তিনি রাজশাহী ত্যাগ করেছেন।
ফায়ার সার্ভির ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, রাজশাহীতে তিন শতাধিক বহুতল ভবন রয়েছে। তবে এগুলোর ৯৯ শতাংশ ভবনেই অনিয়ম রয়েছে। এসব ভবন ঝুঁকি নিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। অধিকাংশ ভবনেই নেই অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। এমনকি রয়েছে বিল্ডিং কোডের অনিয়ম।
এদিকে নকশার অনুমোদন ও ট্রেড লাইসেন্স দিয়েই দায় সারছে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) এবং রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রতিষ্ঠান। আর শুধু ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিরাপদ ভবনের তালিকা করেই দায়িত্ব শেষ করছে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। রাজশাহী নগরীর সাহেববাজার এলাকায় আরডিএ মার্কেট এবং কোর্ট এলাকায় সিটি করপোরেশনের মার্কেট অবস্থিত। এই দুটি বহুতল মার্কেটকে গত পাঁচ বছর আগে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ফায়ার সার্ভিস। অথচ এখনও যথারীতি ব্যবহার হচ্ছে ভবন দুটি। ছুটির দিনসহ বিশেষ দিনগুলোতে এই মার্কেট দুটিতে ক্রেতাদের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা থাকে না।
সূত্রমতে, ভবন নির্মাণের জন্য নকশার অনুমোদন দিয়ে থাকে আরডিএ। আর বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যথাক্রমে হোল্ডিং নম্বর ও ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করে রাসিক বা পৌরসভা। এক্ষেত্রে উভয় প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত ফি আদায় করে। আর একটি বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের কাছেও নকশার অনুমোদন প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে ওই ভবনে ফায়ার সেফটি স্থাপন করা হয়েছে কি না, তা দেখভালের দায়িত্ব এই প্রতিষ্ঠানের।
আরডিএ আবাসিক ও বাণিজ্যিক এই দুই ধরনের ভবনের নকশার অনুমোদন দিয়ে থাকে। তবে রাজশাহীতে সফট কমার্শিয়াল ভবনের নকশার অনুমোদন দেওয়া হয়। কয়েকটি ভবন আছে মার্কেটের জন্য অনুমোদিত। সফট কমার্শিয়াল ভবনে রেসিডেন্স ও অফিস এই দুই ধরনের কার্যক্রমেরই অনুমোদন দেওয়া হয়ে থাকে। তবে অনুমোদন না থাকলেও রাজশাহী নগরীর প্রধান প্রধান সড়কের ধারে অধিকাংশ ভবনই এখন বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব ভবনে ঝুঁকি নিয়ে গড়ে উঠেছে একাধিক রেস্তোরাঁ ও অভিজাত পোশাকের শোরুম। আরডিএ কোনো ভবনে রেস্তোরাঁ নির্মাণের জন্য নকশার অনুমোদন দেয়নি বলে জানা গেছে। প্রসঙ্গত ঝুঁকি বিবেচনায় রেস্তোরাঁ নির্মাণের ভবন নকশায় ভিন্নতা থাকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক রেস্তোরাঁ মালিক জানান, রাজশাহী নগরীতে প্রায় ৪৫০টির মতো হোটেল ও রেস্তোরাঁ রয়েছে। যার মধ্যে সংগঠনভুক্ত ১৫০টি। সরেজমিনে এসব আধুনিক রেস্তোরাঁ ঘুরে দেখা যায়, ভবনের ছাদে নয়তো ভবনের কোনো একটি ফ্লোর ভাড়া করে এগুলো রান্নাঘরসমেত সাজানো হয়েছে। এমনকি অনুমোদিত নকশার বাইরে গিয়ে ভবনের অংশ বাড়িয়েও খোলা হয়েছে কোনো কোনো রেস্তোরাঁ। ভবন মালিকরাও অতিরিক্ত অর্থ পাওয়ায় আবাসিক কিংবা কমার্শিয়াল ভবনেই রেস্তোরাঁ করতে দিচ্ছেন।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় ট্রেড লাইসেন্সেধারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার এবং হোল্ডিং নম্বরের সংখ্যা ৭০ হাজারের বেশি। যা থেকে বার্ষিক রাজস্ব আদায় হয় প্রায় ১৪ কোটি টাকা।
রাসিকের রাজস্ব বিভাগের দাবি, ট্রেড লাইসেন্স দিতে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেখার নির্দেশনা নেই। আর আরডিএর দাবি, তাদের দায়িত্ব হলোÑ ভবন নির্মাণে নকশার অনুমোদন ও অনুমোদনমাফিক কাজ হচ্ছে কি না, তা দেখভাল করা। ট্রেড অ্যান্ড কমার্স দুটি পৃথক বিষয়। যে প্রতিষ্ঠান ট্রেড লাইসেন্স দেয়, তাদের উচিত সংশ্লিষ্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান যেখানে করা হচ্ছে, সেখানে তা ওই ব্যবসার উপযোগী বা ঝুঁকিপূর্ণ কি না, তা নির্ধারণ করা।
আরডিএর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আবাসিক ভবনের জন্য নকশার অনুমোদন দেয় আরডিএ। কেউ যদি ওই ভবনে রেস্তোরাঁ খুলে বসে আর তাকে যদি ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়Ñ এর দায় কার নেওয়া উচিত? ট্রেড লাইসেন্স প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান যদি ওই ভবনের নকশার অনুমোদন দেখে, তবে সহজেই তো বোঝার কথা, ভবনটি কিসের উপযোগী করে নির্মিত। তিনি আরও দাবি করেন, ট্রেড লাইসেন্স প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নিজেদের রাজস্ব বাড়ানোর জন্য কোনো তদারকি ছাড়াই একের পর এক ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে চলেছে। যা ভবনগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলার অন্যতম প্রধান কারণ।
এ ব্যাপারে রাসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আবু সালেহ মো. নূর-ঈ-সাইদ বলেন, ‘ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার সঙ্গে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ভবনের নকশা বা ঝুঁকির বিষয়গুলো দেখার কোনো বিধান নেই। এই বিষয়গুলো দেখবে আরডিএ নয়তো ফায়ার সার্ভিস।
রাজশাহী বিভাগের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক মো. ওহিদুল ইসলাম জানান, ‘রাজশাহীতে তিন শতাধিক বহুতল ভবন রয়েছে। এসব ভবনের ৯৯ শতাংশেই অনয়িম রয়েছে। এসব অনিয়মের বিভিন্ন মাত্রা ও বিভিন্ন দিক রয়েছে। তবে এর বেশি কোনো তথ্য এই মুহূর্তে দেওয়া সম্ভব না।’ কারণ হিসেবে তিনি জানান, গতকাল এক নির্দেশনায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ কোনো প্রকার বক্তব্য দিতে নিষেধ করা হয়েছে।
আরডিএর নগর পরিকল্পক (ভারপ্রাপ্ত) মো. রাহেনুল ইসলাম রনী ও অথরাইজড অফিসার মুহা. আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমের সামনে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে তারা জানান, বিল্ডিং কোডের বিষয়গুলো আরডিএ তদারকি করে থাকে। কোন ভবনে কোন ধরনের ব্যবসা হচ্ছে এবং তা ওই ভবনে ব্যবসার উপযোগী কি না, তা নির্ধারণে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তদারকি করা উচিত বলে জানান তিনি। এদিকে আরডিএর চেয়ারম্যান মো. জিয়াউল হককে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।