× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

চট্টগ্রামে অগ্নিঝুঁকিতে ৩১০০ ভবন ও ৫ লাখ মানুষ

সুবল বড়ুয়া, চট্টগ্রাম

প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৪ ১০:৪৬ এএম

আপডেট : ০৫ মার্চ ২০২৪ ১২:৪৪ পিএম

চট্টগ্রামের নিউ মার্কেট এলাকার রেয়াজউদ্দিন বাজারের দৃশ্য। সরু গলি ও তারের জঞ্জালে ভরা শহরের এ অংশটি অগ্নিনিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছে। রবিবার তোলা। প্রবা ফটো

চট্টগ্রামের নিউ মার্কেট এলাকার রেয়াজউদ্দিন বাজারের দৃশ্য। সরু গলি ও তারের জঞ্জালে ভরা শহরের এ অংশটি অগ্নিনিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছে। রবিবার তোলা। প্রবা ফটো

রাজধানী ঢাকার পরই অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক বা সিডিএ) এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী চট্টগ্রাম মহানগরীতে বর্তমানে বহুতল ভবন রয়েছে সাত হাজার। যার মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ ভবনই অগ্নিঝুঁকিতে। আর ফায়ার সার্ভিসের ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কাল ধরে সম্পাদিত সর্বশেষ জরিপ জানাচ্ছে, চট্টগ্রাম মহানগরীর মোট ১৮ হাজার ৫০০টি বহুতল ভবনের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে ৩ হাজার ১০০টি। এসব ভবনের ১ হাজার ৭৫০টি অতিঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া সাধারণ ঝুঁকিতে রয়েছে ১ হাজার ৩৫০টি। নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করছেন, তদারকি সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক), চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও ফায়ার সার্ভিস ভবন নির্মাণের সময় সঠিকভাবে তত্ত্বাবধান করে না বলেই নগরবাসী এমন মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রাম বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণকক্ষের এক পরিসংখ্যান মতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে মোট ৬৭৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে আগুনে পুড়ে ১৭ জন নিহত এবং ৪৫ জন আহত হয়েছে। আগুনে আনুমানিক ১৭ কোটি ১৩ লাখ ৩১ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে উদ্ধার করা গেছে ১৮৫ কোটি ৬৯ লাখ ৫ হাজার টাকা।

চউকের ২০০৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চট্টগ্রাম মহানগরীতে তিন লাখ ভবন আছে। এর মধ্যে সাত হাজার বহুতল ভবন। তবে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, বর্তমানে বন্দরনগরে ভবন আছে প্রায় ৫ লাখ। এর মধ্যে বহুতলের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার।

অগ্নিঝুঁকিতে ৪৩ এলাকা-স্থাপনা 

২০১৯ সালে ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রাম মহানগরীতে জরিপ চালিয়ে অগ্নিদুর্ঘটনা ঝুঁকিতে থাকা ৪৩টি এলাকা-স্থাপনা চিহ্নিত করে। ওই বছর নারায়ণগঞ্জে হাসেম ফুডসের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জন শ্রমিক পুড়ে মারা যান। এরপর দেশব্যাপী অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে আলোচনার ঝড় বয়ে যায়। তখন এ জরিপ চালানো হয়। এরপর পেরিয়ে গেছে প্রায় ৫ বছর। কিন্তু এখনও চিহ্নিত ওইসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ও স্থাপনাগুলোর বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি চউক ও চসিক। যদিও ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবন ও স্থাপনায় অগ্নিকাণ্ড হলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

এই ৪৩ এলাকা-স্থাপনার মধ্যে রয়েছেÑ নগরীর হক মার্কেট, স্বজন সুপার মার্কেট, বখতেয়ার মার্কেট, নজু মিয়া হাট মার্কেট, বলির হাট মার্কেট, ভেড়া মার্কেট, চাক্তাই চাউল পট্টি, শুঁটকি পট্টি, খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, মিয়াখান নগর পুরাতন ঝুট মার্কেট, ওমর আলী মার্কেট, পোর্ট মার্কেট, বড়পুল বাজার, ইশা মিস্ত্রি মার্কেট, ফকিরহাট মার্কেট, নয়াবাজার মার্কেট, ফইল্ল্যাতলি বাজার, চৌধুরী মার্কেট, রেলওয়ে বস্তি, কলসি দীঘির পাড় এলাকাধীন কলোনি, আকমল আলী এলাকাধীন কলোনি, চকভিউ সুপার মার্কেট, কেয়ারি শপিং মল, গোলজার মার্কেট, রেয়াজউদ্দিন বাজার, জহুর হকার মার্কেট, টেরিবাজার, তামাকমুণ্ডি লেইন, ঝাউতলা বস্তি, আমবাগান বস্তি, সেগুনবাগান বস্তি, কদমতলী রেলওয়ে বস্তি, সিঙ্গাপুর সমবায় সমিতি মার্কেট, কর্ণফুলী মার্কেট, দুই নম্বর গেইট রেলওয়ে বস্তি এলাকা, অক্সিজেন রেল রাস্তা-সংলগ্ন বস্তি, বার্মা কলোনি, ড্রাইভার কলোনি, শেরশাহ কলোনি ও রৌফাবাদ কলোনি।

সরেজমিন : মহানগরের নিউমার্কেট

গতকাল সোমবার বিকালে চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র খ্যাত নিউমার্কেট এলাকার গিয়ে দেখা যায়, বড় সড়কের দুই পাশে বড় বড় মার্কেট আর মালামালের গুদাম। নগরীর আমতল-শাহ আমানত মার্কেট হয়ে নিউমার্কেট যাওয়ার বামপাশে জহুর হকার্স মার্কেটের সরু গলি। যেখানে ছোট-বড় অন্তত ৫০০ দোকান ও কাপড়ের গুদাম রয়েছে। ডানপাশেই বিশাল রেয়াজউদ্দিন বাজার এলাকা। এই বাজারে ছোট ছোট অন্তত ১৭-১৮টি গলি রয়েছে। এসব গলিতে রয়েছে ছোট-বড় অন্তত আট হাজারের বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিদিন এসব প্রতিষ্ঠানে লক্ষাধিক ক্রেতা-বিক্রেতার আনাগোনা ঘটে। অলিগলির এসব দোকানে কখনও যদি অগ্নিকাণ্ড ঘটে, তাহলে বড় ধরনের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। গত বছর এ এলাকার নুপুর মার্কেটে হঠাৎ আগুন ধরে যায়, যা নেভাতে ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের বেগ পেতে হয়। 

এই রেয়াজউদ্দিন বাজারের মতো জহুর হকার্স মার্কেটেরও একই অবস্থা। নেই কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টেরিবাজার, চকভিউ সুপার মার্কেট, কেয়ারি ইলশিয়াম মার্কেটসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকার অলিগলিতে গড়ে ওঠা মার্কেট ও ভবনেও পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। 

যা বলছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা

এ প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক এমডি আবদুল মালেক বলেন, ‘বারবার বলার পরও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিষয়ে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সম্প্রতি আমরা চট্টগ্রাম মহানগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে জরিপ চালিয়েছি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালের এ জরিপের তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রাম মহানগরীতে মোট ১৮ হাজার ৫০০টি ভবন রয়েছে। এর মধ্যে অগ্নিকাণ্ড ও ভূমিকম্পের অতিঝুঁকিতে রয়েছে ১ হাজার ৭৫০টি ভবন। সাধারণ ঝুঁকিতে আছে ১ হাজার ৩৫০টি ভবন। চিহ্নিত এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ৫ লাখের বেশি বাসিন্দা রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের দোকান ও মার্কেটে প্রতিদিন যাওয়া-আসা করছে হাজারো মানুষ। এর বাইরে রেয়াজউদ্দিন বাজার, জহুর হকার্স মার্কেট, টেরিবাজার, তামাকমুণ্ডি লেনসহ আরও অনেক এলাকা রয়েছেÑ যেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ।’

সহকারী পরিচালক বলেন, ‘নগরীর এসব চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন-এলাকাকে ঝুঁকিমুক্ত করতে ইতোমধ্যে ভবন ও দোকান মালিকদের সতর্ক করা হয়েছে। দোকান মালিকদের ডেকে পানির উৎস সৃষ্টি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

তবে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না জানিয়ে সিডিএর ইমারত নির্মাণ কমিটির চেয়ারম্যান ও নগর পরিকল্পনাবিদ ঈসা আনসারী বলেন, ‘ভবন নির্মাণে অনুমোদনের ক্ষেত্রে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি ভবন নির্মাণের সময় জায়গা অনুসারে ভবনের চারপাশে খালি জায়গা রাখা বাধ্যতামূলক। এরপরও মালিকরা ভবন নির্মাণে ব্যত্যয় করেন। কিন্তু চউক ইমারত আইন মেনেই ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়ে থাকে।’

ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে তদারকি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চউকের অথরাউজড অফিসার-২ তানজিব হোসেন বলেন, ‘ভবন অনুমোদনে ফায়ার সেফটি ও পরিবেশের ছাড়পত্র দেখে চউক ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়ে থাকে। অগ্নিকাণ্ডের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতেও তাগাদা দেওয়া হয়। তবে কমার্শিয়াল ভবন নির্মাণের অনুমোদনের পর যে ট্রেড লাইন্সেস দেওয়া হয়, সেটার দায়িত্ব চউকের নয়। এই ট্রেড লাইন্সেস দেওয়ার সময় অবশ্যই অগ্নিনিরাপত্তাসহ সামগ্রিক বিষয় দেখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সংস্থার। ভবন নির্মাণের সব দায়-দায়িত্ব চউকের ওপর দিলে হবে না। আমরা চকবাজার, দেবপাহাড়সহ আরও একাধিক এলাকায় ইমারত আইন ভেঙে ভবন নির্মাণ করায় ভবন মালিককে জরিমানা করেছি। পাশাপাশি প্ল্যান অনুসারে ভবন নির্মাণে বাধ্য করেছি।’

সঠিক তদারকি হলে মৃত্যুঝুঁকি কমে আসবে

তবে তদারকি সংস্থাগুলো ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে তদারকি করলে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঝুঁকি কমে আসবে বলে দাবি করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরনগরে ৯০ শতাংশ বহুতল ভবনই অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় সেখানে বসবাসকারী ও যাতায়াতকারী সকলেই ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ঝুঁকি কাটাতে হলে সঠিক পরিকল্পনা নিতে হবে। কোথাও বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড হলে তদারকি সংস্থাগুলো নড়েচড়ে বসে। কিন্তু ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে তদারকি সংস্থা চউক, চসিক ও ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে এই ঝুঁকি তৈরি হতো না।’

স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, শুধু আইন অনুযায়ী ভবনের নকশা দেখে অনমুতি দেওয়ার ক্ষেত্রে নয়, ভবন নির্মাণের সময়ও চউককে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। যেমন চট্টগ্রামের প্রায় সব বহুতল ভবনের বারান্দাই গ্রিল দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সিঁড়ির পরিসরও সংকীর্ণ। সামান্য টাকা বাঁচাতে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার দিকে ভবন মালিকরা নজর দেন না। ফায়ার সার্ভিসও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না। কারণ ভবন নির্মাণের সময় সঠিকভাবে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কি না, তা তদারকি করলে এই ঝুঁকি দেখা দেবে না ’ তিনি বলেন, ‘মূলত প্রয়োজন হলো, তদারকি সংস্থাগুলোর তদারকি বাড়ানো। আইন প্রয়োগে কঠোর হতে হবে। নির্দেশনা না মানলে ভবন ভেঙে দিতে হবে।’


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা