আবু রায়হান তানিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৪ ১৫:৫৮ পিএম
আপডেট : ০২ মার্চ ২০২৪ ১৬:৪৬ পিএম
ফাইল ফটো
চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন গুলবাগ আবাসিকের বাসিন্দা মো. আবু বক্কর সিদ্দিক। সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সার তিনি। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার দিকে তাকেসহ ফয়জুল আমিন নামে আরও একজনকে গুলবাগ আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের একটি দল। পরদিন মঙ্গলবার বিকালে অনলাইন জুয়া খেলার অভিযোগে সিএমপি অধ্যাদেশে একটি নন এফআইআর মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে চালান করে ডিবি পুলিশ। আদালত তাদের ১০০ টাকা হারে জরিমানা করে মুক্তি দেন।
তবে আদালতে পাঠানোর আগ পর্যন্ত ডিবি পুলিশের হেফাজতে থাকাকালে ফ্রিল্যান্সার আবু বক্কর গোয়েন্দা পুলিশের দলটির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন। তার অভিযোগ, তার নিজের বাইন্যান্স (ক্রিপ্টোকারেন্সি একচেঞ্জ; যা বাংলাদেশে অবৈধ) অ্যাকাউন্ট থেকে ৪ দশমিক ৯৭৩৭ বিটকয়েন খোয়া গেছে। ডলারের হিসেবে এর পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ৭২ হাজার ডলার। প্রতি ডলার ১১০ টাকায় যা ২ কোটি ৯৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। আবু বক্করের দাবি, ছাড়া পেতে ১০ লাখ টাকা দেওয়ার পরও ডিবি পুলিশের সদস্যরা তার বিটকয়েন হাতিয়ে নিয়েছেন। এই ফ্রিল্যান্সার বলেন, তারা তার ক্রিপ্টোকারেন্সির বিষয়ে জানত।
বাইন্যান্স অ্যাকাউন্ট পরিচালনা ও বিটকয়েন ব্যবহারের কথা প্রতিদিনের বাংলাদেশের কাছে স্বীকার করেছেন আবু বক্কর সিদ্দিক। কিন্তু দেশে বিটকয়েন ব্যবহার অবৈধ হলেও আদালতকে এ বিষয়ে অবহিত করেনি গোয়েন্দা পুলিশ। মামলার আর্জিতেও বিটকয়েনের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। শুধু লেখা হয়েছে, অনলাইন জুয়া খেলার অপরাধে আসামিদের গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক রুহুল আমিনের নেতৃত্বে গ্রেপ্তার করা হয়।
আদালতের মাধ্যমে মুক্তি পাওয়ার পর আবু বক্কর সিদ্দিক অভিযোগ তুলেছেন, গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তারা তার মোবাইল ফোন ব্যবহার করে বাইন্যান্স অ্যাকাউন্ট থেকে এসব বিটকয়েন হাতিয়ে নিয়েছেন।
অনলাইন জুয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া আবু বক্করের দাবি, পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেতে ১০ লাখ টাকা পুলিশের দেওয়া দুটি ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হয়। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে আবু বক্কর বলেন, ‘সোমবার রাত ৯টার দিকে সাদা পোশাকের একদল লোক আমি ও আমার বন্ধু আমিনকে গাড়িতে তুলে নেয়। শুরুতে মনে করেছিলাম তারা আমাদের অপহরণ করছে। তখন আমি তাদের ৫ লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করি। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে আটককারীরা (পুলিশ) টাকা নেয়নি এবং পরে তারা আমাদের মুনসুরাবাদের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। তখন বুঝতে পারি, গোয়েন্দা পুলিশ আমাদের আটক করেছে। সেখানে ইন্সপেক্টর রুহুল আমিনের নেতৃত্বাধীন দল আমাদের গ্রেপ্তার করেছে বলে জানতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুরুতে পুলিশ বলছিল আমি মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে পুলিশ সাদা স্কচটেপে আমার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেয়। আমার মোবাইলেও বারবার আমার আঙুলের ছাপ নিচ্ছিল। রাত ১২টার দিকে পুলিশ আমাকে জানায়, আটকের সময় আমি পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলাম, সেই জায়গায় যদি ১০ লাখ টাকা দিই, তাহলে পরদিন আমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।’
এই ফ্রিল্যান্সার দাবি করেন, ‘পুলিশের প্রস্তাবে আমি রাজি হয়ে তাদের দেওয়া দুটি ব্যাংক হিসাবে পাঁচ লাখ করে ১০ লাখ টাকা দিই। কিন্তু পরদিন তারা আমাকে আদালতে চালান করে দেয়। আদালত থেকে মুক্তি পেয়ে বাসায় ফিরে আমার বাইন্যান্স অ্যাকাউন্ট চেক করে দেখি ওই অ্যাকাউন্টে মাত্র ৫ হাজার ৭৯৩ ডলার আছে। অথচ ওই অ্যাকাউন্টে ২ লাখ ৭৭ হাজার ডলার ছিল। পরে অ্যাকাউন্ট চেক করে দেখি সোমবার রাত ১১টা ৪০ মিনিটে আমার বাইন্যান্স অ্যাকাউন্ট থেকে ৪ দশমিক ৯৭৩৭ বিটকয়েন সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’
‘বিটকয়েন স্থানান্তরের সময় আমি ডিবি পুলিশের হেফাজতে ছিলাম। তারা মোবাইল উল্টো দিকে রেখে আমার আঙুলের ছাপ নিচ্ছিল,’ যোগ করেন আবু বক্কর সিদ্দিক।
তার দাবি, ডিবি হেফাজতে থাকা অবস্থায় আবু বক্করের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে সিটি ব্যাংক এবং ইউসিবিএল ব্যাংকের দুটি হিসাবে পাঁচ লাখ টাকা করে ১০ লাখ টাকা স্থানান্তর করে নেওয়া হয়েছে। ব্যাংক হিসাব দুটির মধ্যে একটি ইউসিবিএল ব্যাংকের পাহাড়তলী শাখার ০৯৭৩২০১০০০০৩৮৯৪৩ নম্বর হিসাব পরিচালিত হচ্ছে জাহেদ হোসাইন স্বাধীন নামে ব্যক্তির নামে। সিটি ব্যাংকের ১৭৮১৪৩***০৫৫৫ নম্বরটিও পরিচালিত হচ্ছে একই নামে।
পাহাড়তলী এলাকায় একজন জাহেদ হোসাইন স্বাধীন বসবাস করেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তবে ওই জাহেদ পুলিশের সোর্স বলে জানা গেছে। তাকে ফোন করলেও ফোন ধরেনি কেউ। ফলে ব্যাংক হিসাবধারী জাহেদ এবং পুলিশের কথিত সোর্স জাহেদ একই ব্যক্তি কি না, তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
আবু বক্করের অভিযোগের সময়ের বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান করে দেখা গেছে, পুলিশের দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছেÑ সোমবার রাত ৮টা ১৫ মিনিটের সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। আর আদালতে পাঠানো হয় পরদিন মঙ্গলবার। আটক থেকে আদালতে সোপর্দ পর্যন্ত প্রায় ১৯ ঘণ্টা বক্কর গোয়েন্দা পুলিশ হেফাজতে ছিলেন। আর তার মোবাইল ফোনে থাকা তথ্য অনুযায়ী, বিটকয়েন স্থান্তারিত হয়েছে সোমবার দিবাগত রাত ১১টা ৪০ মিনিটের সময়।
বিটকয়েন ব্যবহার বাংলাদেশে বৈধ নয়Ñ এমন কথা স্মরণ করিয়ে দিলে আবু বক্কর দাবি করেন, ‘আমি একজন নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সার। ৮ বছর ধরে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে আয় করছি। আয়ের টাকা আমরা বাইন্যান্সেই লেনদেন করি। বাংলাদেশে অবৈধ হলেও বিশ্বের অনেক দেশে বৈধ। তাই বিটকয়েনগুলো আমার বৈধ আয়। তারপরও অপরাধ হলে এ বিষয়ে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারত। কিন্তু আমার অজান্তে মোবাইল ফোন থেকে কৌশলে সরিয়ে নিল কেন?’
তার দাবি, ‘এই বিটকয়েন যে অ্যাকাউন্টে স্থান্তারিত হয়েছে, সেই লিংক আছে। তা ধরে অনুসন্ধান করেই সত্য বেরিয়ে আসবে।’
মঙ্গলবার যে নন এফআইআর মামলায় আবু বক্করকে আদালতে পাঠানো হয় সেই মামলার বাদী সিএমপির ডিবি দক্ষিণ জোনের পরিদর্শক মো. আলমগীর হোসেন। মামলার তথ্য অনুযায়ী, সোমবার রাত ৮টা ১৫ মিনিটে অনলাইন জুয়া খেলার অপরাধে তাকে পরিদর্শক রুহুল আমিনের নেতৃত্বে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন বিকালে তাকে আদালতে হাজির করা হয়। মামলায় তার মোবাইল জব্দ দেখিয়ে মোবাইলে অনলাইন জুয়ার আলামত পাওয়ার কথা বলা হলেও বিটকয়েন ব্যবহারের বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। ওই মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে আল বারাকা এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. নুরুল আরেফিন, এহসানুল ইসলাম, পরিদর্শক রুহুল আমিন, উপপরিদর্শক মৃদুল কান্তি দে, বাবুল মিয়া, সহকারী উপপরিদর্শক শাহপরান জান্নাত, কনস্টেবল মুমিনুল হক ও কনস্টেবল আব্দুর রহমানকে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক রুহুল আমিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আবু বক্করসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের মোবাইল জব্দ করে আদালতে সোপর্দ করা হয়। কিন্তু তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা বা বিটকয়েন সরানোর বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’
এই পরিদর্শক আরও বলেন, ‘আবু বক্কর আমাদের এক অফিসারের আত্মীয়। তার সম্মানে আবু বক্করের মোবাইল তাকে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে নিজের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে তিনি কী করেছেন তা আমি জানি না।’
আবু বক্কর বিটকয়েন ব্যবহার এবং স্থানান্তরের দাবি করলেও মামলায় বিটকয়েন সম্পর্কিত তথ্যাদি না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি ঠিক জানি না।’
একই সঙ্গে ডিবি হেফাজতে থাকা অবস্থায় বক্করের ব্যাংক হিসাব থেকে অপর দুটি ব্যাংক হিসাবে ১০ লাখ স্থানান্তরের বিষয়েও কিছু জানেন না বলে দাবি করেন এই পরিদর্শক।
এসব বিষয়ে কথা বলতে মামলার বাদী পরিদর্শক মো. আলমগীর হোসেনকে ফোন দিলেও তিনি ধরেননি।
চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা (উত্তর-দক্ষিণ) পুলিশের উপকমিশনার মোসা. সাদিরা খাতুন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি কিছুটা শুনেছি। কিন্তু কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেব।’