× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

‘মাতৃভাষার ব্যবহারে আমরা উদাসীন’

কাওছার আহমদ, সিলেট

প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:২৮ এএম

আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:১৭ এএম

ভাষাসৈনিক অধ্যক্ষ মাসউদ খান। প্রবা ফটো

ভাষাসৈনিক অধ্যক্ষ মাসউদ খান। প্রবা ফটো

রাষ্ট্র ভাষা নিয়ে পাকিস্তানে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল তার সঙ্গে শুরু থেকেই যুক্ত হয়েছিলেন সিলেটের বুদ্ধিজীবীরা। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণা দিলে ঢাকায় যে প্রতিবাদ শুরু হয় তার সঙ্গে সরাসরি আন্দোলনে যুক্ত হয় সিলেটের ছাত্র ও রাজনীতিবিদরা। কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের অনুরূপ কর্মসূচি পালিত হতে থাকে সিলেটেও। এই জেলার অনেক কিশোর-তরুণ এ আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন সক্রিয়ভাবে। তাদের মধ্যে অন্যতম অধ্যক্ষ মো. মাসউদ খান ও অধ্যাপক আবদুল আজিজ। যারা কিশোর অবস্থায় নিজেদের ভাষা সংগ্রামে সম্পৃক্ত করেছিলেন। অধ্যাপক আবদুল আজিজ বর্তমানে বার্ধক্যজনিত নানা অসুস্থতায় ভুগছেন। কানে কম শোনেন, কথা বলতে কষ্ট হয়। প্রয়োজন ছাড়া কারও সঙ্গে আলাপে আগ্রহ দেখান না। 

অধ্যক্ষ মো. মাসউদ খানের বয়স নব্বুইয়ের কোঠায় হলেও বেশ সচল তিনি। ভাষা আন্দোলনের আগুনঝরা দিনগুলোর স্মৃতি এখনও তার বেশ টনটনে। সম্প্রতি আড্ডা হয় তার সঙ্গে। কথায় কথায় জানান নিজের জীবনের অনেক গল্প। বলেন, সিলেট অঞ্চলে ভাষা আন্দোলনের দিনগুলো কেমন ছিল। 

অধ্যক্ষ মো. মাসউদ খানের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৮ আগস্ট সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার শেওলা ইউনিয়নের কাকরদি গ্রামে। তার পিতার নাম ফয়াজ আলী খান এবং মাতার নাম আজিজুন নেছা। গ্রামের বাড়িতে বেশি দিন থাকা হয়নি তার। ১৯৪৪ সালে কৈশোরে সিলেট নগরীর মানিকপীর সড়কের বাসায় চলে আসেন। সেখানে মক্তবে যাওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় তার লেখাপড়া। প্রথমে ভর্তি হন কাজী জালালউদ্দিন বালক মক্তবে। মক্তবের লেখাপড়া শেষ করে সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করে সিলেট এমসি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ডিগ্রি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। পরবর্তীতে ঢাকার সিটি ল’ কলেজ থেকে এলএলবি সম্পন্ন করে সিলেটের মদন মোহন কলেজে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি সিলেট জেলা বারে আইন পেশাও শুরু করেন। তবে আইন পেশায় বেশি দিন থাকেননি। মদন মোহন কলেজের উপাধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত মদন মোহন কলেজে শিক্ষকতা করেন। এরপর মওলানা ভাসানীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে টাঙ্গাইল চলে যান।

টাঙ্গাইলে মওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় টেকনিক্যাল কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। সেখানে প্রায় ১০ বছর দায়িত্ব পালন করে ১৯৮৬ সালে ঢাকায় গিয়ে পারিবারিক ব্যবসায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। তিনি কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের দু’বার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া ৩১ বছর বয়সেই তিনি শেওলা ইউপির চেয়ারম্যান এবং সিলেট জেলা কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। অধ্যক্ষ মাসউদ ছাত্র ইউনিয়ন, তমদ্দুন মজলিস, ছাত্রশক্তি, প্রগতিশীল ছাত্রদল, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তিনি খেলাফত মজলিসের রাজনীতিতেও জড়িত ছিলেন। 

ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও ভূমিকা রাখেন মাসউদ খান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদাররা তার গ্রামের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। মাসউদ খানের বড় ভাই সা‘দত খান ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন।

ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে মাসউদ খান বলেন, অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাবস্থায় ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি। ভাষা আন্দোলনের শুরুতে সিলেটে হাতে গোনা যে কজন স্কুল ও কলেজ ছাত্র সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে আমি ছিলাম একজন। আমার বড় ভাই সা’দত খান রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি। ফলে পারিবারিকভাবে আমিও রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলাম। ভাষা আন্দোলনে সিলেটে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিল। পীর হাবীবুর রহমান ও আমার ভাই সা’দত খান যুব নেতৃত্বে ছিলেন। ভাষা আন্দোলন শুরু হলে আমাকে স্কুলের ছাত্রদের সংগঠিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমি সিলেট শহরের আলিয়া মাদ্রাসা, রসময় মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় ও দি এইডেড হাই স্কুলের ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ঢাকা থেকে ঘোষিত প্রত্যেকটি কর্মসূচিতে এই তিন প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের নিয়ে অংশগ্রহণ করতাম। এখন নগরীর যে জায়গায় হাসান মার্কেট, সেখানে আগে ছিল গোবিন্দচরণ পার্ক। এই পার্কেই জনসভা করতাম। দুপুরের দিকে মিটিং শুরু হয়ে বিকাল ৩টায় শেষ হতো। আবার বিকাল ৫টায় শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলত। ঢাকার পরিস্থিতি জানানোর জন্যই মূলত বিকালে মিটিং হতো। ঢাকার খবর পেয়ে পরের দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হতো।

আন্দোলন চলাকালে বিশেষ কোনো ঘটনার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘটনাটি আন্দোলন সংশ্লিষ্ট নয়, তবে মুখরোচক। সকালের মিটিংয়ের পর প্রায় ২ ঘণ্টা বিরতি ছিল। এরপর বিকালে আবার মিটিং হতো। জনসভাস্থলের পাশে সিলেট জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের সামনে একটা বড় খেলার মাঠ ছিল। মাঠের চারপাশে গাছগাছালিও ছিল। এই বিরতির সময় আমরা আন্দোলনকারীরা সেখানে বসে নাস্তা খেতাম ও আড্ডা দিতাম। এখনকার মতো শহরে তখন এত রেস্টুরেন্ট ছিল না। এরপর আবার বিকালের মিটিংয়ে উপস্থিত হতাম। একটা টেবিল ও চেয়ার সংগ্রহ করে মিটিং শুরু হতো। টেবিল ও চেয়ারের ভাড়া ছিল আট আনা। সেই দৃশ্যগুলো আজও মনে পড়ে।

ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়, সেই সময়ে এমন কিছু অনুভব করেছিলেন কি না জানতে চাইলে মাসউদ খান বলেন, আসলে সেই সময়ে অনুভব করার সময় নয়। কারণ পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে। আর প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সালে এবং সেই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায় তমদ্দুন মজলিশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিশ গঠিত হয়। এটিই ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগঠন। ভাষা আন্দোলনের শুরুর দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে ছিলেন কিন্তু তার সমর্থন ছিল। পরবর্তীতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীও আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন। তমদ্দুন মজলিশ ইসলামি ভাবধারার একটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। দেশে ইসলামি আদর্শ ও ভাবধারা সমুন্নত করার প্রত্যয় নিয়ে ভারত ভাগের পরেই ঢাকায় গড়ে ওঠে সংগঠনটি। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ শুরু হয় ঢাকায়। ছাত্রদের মিছিলে যখন পুলিশ গুলি করে তখন এ আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শহরে শহরে শুরু হয় প্রতিবাদ মিছিল-মিটিং। আন্দোলনের দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। এভাবেই ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। পরবর্তীতে বাঙালির দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। 

ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছরও দেশের উচ্চ শিক্ষাসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আমাদের আন্দোলন ছিল সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের জন্য। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় মুসলিম লীগ এদেশের শাসনে ছিল। তখন মুসলিম লীগের বিরদ্ধে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়েছিল এবং যুক্তফন্টের কর্মসূচির ২১ দফা দাবির মধ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি লাভ করে। এত ত্যাগের বিনিময়ে অর্জনের পর আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিকÑ এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেও বাংলা ভাষার সঠিক প্রচলন হয়নি। বিষয়টি দুঃখজনক। বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোয় সরকার শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে তাদের মাতৃভাষার সঠিক ব্যবহার করছে কিন্তু আমরা উদাসীন। মাতৃভাষা মহান আল্লাহর একটি অপরূপ দান।

২১ ফেব্রুয়ারি এখন সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এই অনন্য অর্জনকে তিনি বাঙালি জাতির গৌরবের বিষয় হিসেবে অভিহিত করে বলেন, বাংলা ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, এটাকে আমি বড় সাফল্য মনে করি। আমাদের আন্দোলন আর ত্যাগের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলেছে, এটা গর্বের বিষয়। 

ভাষাসৈনিক অধ্যক্ষ মাসউদ খানের এখনকার দিন কাটে বাসায়। সময় কাটান বই আর পত্রিকা পড়ে। মাঝেমধ্যে সাহিত্য সংসদে যান। আর বাসায় কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী এলে মেতে ওঠেন আলাপ-আলোচনায়।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা