সুফল চাকমা, বান্দরবান
প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:৪৩ পিএম
আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৪:৫০ পিএম
থংপং পাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ম্রো ভাষা শেখানো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। সম্প্রতি তোলা। প্রবা ফটো
পার্বত্য জেলা বান্দরবানের প্রত্যন্ত দুর্গম এলাকা থংপং পাড়া। জেলা শহর থেকে অন্তত ১০০ কিলোমিটার দূরে। লামা উপজেলা রূপসী পাড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ক্রাউডং (ডিম পাহাড়) পাহাড়ে অবস্থিত পাড়াটি। যেখানে চলছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ম্রো সম্প্রদায়ের ভাষা টিকিয়ে রাখার লড়াই। সেখানে প্রথমে একটি বেসরকারি হোস্টেলের শিক্ষার্থীদের দিয়ে এই চর্চা শুরু হয়। পরে গড়ে তোলা হয় একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দুই প্রতিষ্ঠানে জাতীয় শিক্ষাক্রমের বাইরে নির্দিষ্ট সময়ে হাতেকলমে শেখানো হচ্ছে ম্রো ভাষা।
রুংলে থারবা নামের হোস্টেলটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ২০০৯ সালে। এটির উদ্যোক্তা ম্রো সম্প্রদায়ের লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো। দুই বছর পর পাড়াবাসীর উদ্যোগে হোস্টেলের পাশেই গড়ে তোলা হয় থংপং পাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
হোস্টেলে ম্রো ভাষার শিক্ষক মেন নং ম্রো বলেন, হোস্টেলে শিক্ষার্থীদের ম্রো ভাষার স্বরবর্ণ ও ব্যাঞ্জনবর্ণ শেখানো হয়। নিজেদের ভাষা শেখানোর সঙ্গে ইয়াংঙান ম্রো’র লেখা কিছু বই শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে। ভাষার ওপর দক্ষতা অর্জন যাচাই করার জন্য পরীক্ষা নেওয়া হয়।
ম্রো সম্প্রদায় থেকে ২০২২ সালে প্রথম এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন সং নং ম্রো। থানছি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া এই শিক্ষার্থী বলেন, ম্রো সম্প্রদায়ের শিশুরা যখন প্রথম স্কুলে যায় তারা বাংলা ভাষা মোটেই বুঝে উঠতে পারে না। নিজেদের ভাষা দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হলে তা সুবিধার হয়। প্রাথমিকে নিজের ভাষায় শিক্ষা মজবুত হওয়ায় আমি এসএসসিতে ভালো ফল করেছি।
থংপং পাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মেন রন ম্রো বলেন, এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিশেষত্ব হচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি ম্রো ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করা হয়। এই বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা ম্রো ভাষায় পেয়ে শিক্ষার্থী পিইসি ও এসএসসিতে ভালো ফল করছে।
থংপং পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তুম রুই ম্রো বলেন, একজন ম্রো শিক্ষার্থী যখন বিদ্যালয়ে যায় প্রথমে সে ভাষা নিয়ে সমস্যায় পড়ে। দেখা যাচ্ছে শিক্ষার্থী ম্রো সম্প্রদায়ের, শিক্ষক অন্য সম্প্রদায়ের– তখন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক একে অপরের ভাষা কেউই বোঝেন না। বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিজের সম্প্রদায়ের হলে শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ নিবিড় হয়। শিশুর প্রাথমিক শিক্ষালাভ হয় আনন্দের। যদি বিপরীত হয় তাহলে একজন ম্রো শিশুর শিক্ষালাভ করা স্বপ্নই থেকে যায়।
ম্রো সম্প্রদায়ের লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো বলেন, আমি গ্রাম ছেড়ে যখন ম্রো আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন নিজের ভাষা ছাড়া কোনো ভাষা জানতাম না। অন্য সম্প্রদায়ের শিক্ষকরা কী পড়াচ্ছেন কিছুই বুঝতাম না। বড় হয়ে ছোটবেলায় নিজের অভিজ্ঞতার কথা ভেবে মাত্র ১৫ জন ছাত্র দিয়ে রুংলে থারবা হোস্টেলটির যাত্রা শুরু করি। বর্তমানে এখানে ১০৭ জন শিক্ষার্থী আছে। ২০০৯ সালে বাঁশের বেড়া দিয়ে হোস্টেলটি শুরু করেছিলাম। ২০২০-২১ অর্থবছরে সেটিকে একতলা ভবন হিসেবে নির্মাণ করে দেয় জেলা পরিষদ। হোস্টেলে স্বল্পমূল্যে লেখাপড়ার পাশাপাশি থাকা ও খাওয়ার সুবিধা পেয়ে থাকে শিক্ষার্থীরা।
বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের আহ্বায়ক সিং ইয়ং ম্রো বলেন, ওই এলাকাটি ম্রো অধ্যুষিত। এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় প্রাথমিক শিক্ষায় নিজেদের বর্ণমালা শেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বান্দরবানে ম্রোদের শিক্ষার হার বাড়ছে। ৫০ হাজারের বেশি ম্রো সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে নিরক্ষতার হার প্রায় ৭০ শতাংশ। এখন ম্রো গ্রামের কেউ আর ‘টিপসই’ দেয় না। সবাই মোটামুটি নিজেদের বর্ণমালা লেখায় স্বাক্ষর করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জেলা পরিষদের গবেষণা সেল আছে। সেখান থেকে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ণমালা শেখানো ও বই প্রকাশনার কাজ করা হয়। কিন্তু কাউকে বর্ণমালা শেখার জন্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় না। জেলা পরিষদ থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ণমালার ভাষা শেখার জন্য শিক্ষকদের সহায়তা করার বিষয়টি বিবেচনাধীন আছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্দুল মান্নান বলেন, ২০১৭ সাল থেকে পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ণমালায় প্রাথমিকের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া শুরু হয়েছে। ম্রো সম্প্রদায়ের বর্ণমালায় এখনও জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বই বের করেনি। ম্রো বর্ণমালার শিক্ষককে আলাদা করে বেতন দেওয়ার মতো প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ থেকে বরাদ্দ নেই। আগামাীতে ম্রো বর্ণমালায় বই বের করা ও ম্রো ভাষার শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার ব্যাপারে বিবেচনা করা হবে।