সীমান্ত পরিস্থিতি
কক্সবাজার অফিস
প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:১৮ পিএম
আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:২০ পিএম
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ জেটিতে স্থানীয়দের পাশাপাশি পর্যটকদের চলাচল বন্ধ রেখে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। সোমবার দুপুরে। প্রবা ফটো
টেকনাফের কাছে নাফ নদের ওপারে আরাকান শহর মংডুর আশপাশে যুদ্ধ তীব্রতর হয়েছে বলে সীমান্তের বাসিন্দারা জানিয়েছেন। টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আব্দুস সালাম বলেন, সোমবার ভোর থেকে আবার তীব্র গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছেন তারা।
তিনি বলেন, ‘নানা মাধ্যমে খবর পাচ্ছি, মংডু শহরের আশপাশের মেগিচং, কাদিরবিল, নুরুল্লাপাড়া, মাঙ্গালা, নলবন্ন্যা, ফাদংচা ও হাসুরাতা এলাকায় দেশটির সরকারি ও আরাকান আর্মির মধ্যে তীব্র লড়াই চলছে। ওই এলাকাগুলো রোহিঙ্গা অধ্যুষিত। সেখানকার বাসিন্দারা প্রাণ বাঁচাতে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে ছুটছে। অনেকে বাংলাদেশ সীমান্তের নদী ও খালে অবস্থান নিয়েছে।’
এ নিয়ে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তের নাফ নদ দিয়ে আবারও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় লোকজন ও জনপ্রতিনিধিরা।
আরাকান আর্মির বরাতে ইরাবতী জানিয়েছে, জান্তা উত্তর রাখাইন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করছে এবং রাজ্যের দক্ষিণে বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে আক্রমণ বাড়িয়েছে। যুদ্ধে হেরে যাওয়ায় জান্তা সরকার এই নীতি গ্রহণ করছে বলে আরাকান আর্মির দাবি। রবিবার রাখাইন রাজ্যের মায়বন শহরের দুটি পাহাড় থেকে জান্তা তাদের সৈন্যদের হেলিকপ্টারে করে দক্ষিণে সরিয়ে নেওয়ার পর বিবৃতি দেয় স্বাধীনতাকামী আরাকান আর্মি। তাদের দাবি, জান্তার সেনারা যদি প্রতিরোধ গড়তে আসে তবে অবশ্যই হারবে। আর সেই পরাজয় এড়াতে আগেভাগে সৈন্যদের সরিয়ে নিয়েছে তারা।
বিবৃতিতে বলা হয়, মায়বন শহরের ৪০২ ও ৪০৮ নম্বর ফাঁড়ি দুটির অস্ত্র, গোলাবারুদ ও কামান সোমবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ধ্বংস করা হয়েছে। সেখানে থেকে কেবল বহনযোগ্য অস্ত্রসহ হেলিকপ্টারে সৈন্যদের রাখাইনের উত্তরাংশ থেকে দক্ষিণাংশের অ্যান শহরে নিয়েছে জান্তা সরকার। এই অঞ্চলের রামরিতে স্থল, নৌ ও আকাশপথে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে জান্তার সৈন্যরা। গত শনিবার ৪ নম্বর কিং তায়ে ওয়ার্ডে অন্তত দেড়শ বসতঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সপ্তাহজুড়ে অন্য শহরগুলোতে সংঘর্ষ-সংঘাত বৃদ্ধি পেয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সব ঘাঁটি ও ফাঁড়ির সৈন্যরা আত্মসমর্পণ না করবে, ততক্ষণ আক্রমণ চালিয়ে যাবে আরাকান আর্মি।
বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যে পরাজয়ের বাস্তবতা এখনও মেনে নিতে পারেনি জান্তা সরকার। তারা সাধারণ মানুষের ওপর সন্ত্রাসী কায়দায় হামলা করছে এবং যোগাযোগ, তথ্য ও পণ্য থেকে পশ্চিমের রাজ্যকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। রাজ্যের ঘাঁটি ও ফাঁড়িগুলো ঘিরে জান্তার সৈন্যরা মাইন বসাচ্ছে।
গত বছরের ২৭ অক্টোবর উত্তরের শান রাজ্যে অপারেশন ১০২৭ শুরু করে আরাকান আর্মি। নভেম্বরে রাজ্যের উত্তরাংশে এবং চিন রাজ্যঘেঁষা পালেতোয়া শহরে শাসকসৈন্যদের বিরুদ্ধে বিস্তৃত পরিসরে অভিযান জোরদার করেছে এই বিদ্রোহীরা। তাদের দাবি, রাখাইন রাজ্যে এখন পর্যন্ত ১৭০টির বেশি ঘাঁটি ও ফাঁড়ি দখল করে নিয়েছে আরাকান আর্মি। এ ছাড়া দখলে নিয়েছে পাউকতাও, কিয়কতাও, মিনবিয়া, ম্রাউক-ইউ, তাংপিওলেটওয়ে ও মায়বন শহর।
এই যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় আতঙ্কে ভুগছেন টেকনাফ সীমান্তের বাংলাদেশিরা। টেকনাফের সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য খোরশেদ আলম বলেন, টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে। স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নেমেছে। বেকার রয়েছে টেকনাফ স্থলবন্দরের শ্রমিক ও ১২ হাজার জেলে। সব মিলিয়ে আশান্তির মধ্যে বাস করছেন টেকনাফ সীমান্তের বাংলাদেশিরা।
সীমান্তে নিখোঁজের ১৭ দিন পর জেলের মরদেহ উদ্ধার
মিয়ানমারে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে কক্সবাজার সীমান্তে নাফ নদে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়ার ১৭ দিন পর এক জেলের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। স্বজনদের দাবি, আরাকান আর্মির সদস্যরা ওই জেলেকে অপহরণ করেছিল। উখিয়া থানার ওসি মো. শামীম হোসেন জানান, রবিবার রাতে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল সীমান্তের নাফ নদের তীরের বেড়িবাঁধ থেকে মরদেহটি উদ্ধার করে তারা। নিহত মোস্তাফিজুর রহমান পালংখালী ইউনিয়নের আঞ্জুমানপাড়ার মৃত আব্দুস ছালামের ছেলে।
নিহতের ছোট ভাই মো. আমির হোসেন বলেন, গত ১ ফেব্রুয়ারি সকালে নাফ নদে অন্য জেলেদের সাথে তার ভাই মাছ ধরতে যান। আরাকান আর্মির সদস্যরা অস্ত্রের মুখে জিন্মি করে তাকে তুলে নিয়ে যায়। বিষয়টি বিজিবি ও পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের অবহিত করা হলেও তার ভাইয়ের সন্ধান পাননি। অপহরণকারীরা স্বজনদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগও করেনি।
তিনি বলেন, মোস্তাফিজুর রহমানের শরীরে কোনো ধরনের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে তার পায়ে শেকল বাঁধার চিহ্ন রয়েছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে, অপহরণকারীরা তাকে বেঁধে রাখায় অনাহারে মৃত্যুর পর মরদেহ বাংলাদেশ অভ্যন্তরে ফেলে রেখে যায়। এ বিষয়ে ওসি মো. শামীম হোসেন বলেন, তার অপহরণের বিষয়টি পুলিশ নিশ্চিত হতে পারেনি।
অস্ত্রধারী ২৩ রোহিঙ্গার মধ্যে এবার অন্য ১১ জন রিমান্ডে
মিয়ানমার থেকে অস্ত্রসহ অনুপ্রবেশকারী সেই ২৩ রোহিঙ্গার মধ্যে অন্য ১১ জনকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। একই সঙ্গে এর আগে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া ১১ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে ফেরত পাঠিয়েছে। গতকাল সোমবার কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গ্যার আদালত এসব আদেশ দেন বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নাছির উদ্দিন মজুমদার।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সংঘাতের মধ্যে পালিয়ে আসা অস্ত্রধারী ২৩ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করে। বিজিবি-৩৪ ব্যাটালিয়নের পালংখালী বিওপির নায়েব সুবেদার মো. শহিদুল ইসলাম মামলা করে তাদের পুলিশে দেন। ১২ ফেব্রুয়ারি শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গ্যার আদালত ২২ জনের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গ্রেপ্তারের পর কারাগারে থাকা মো. সাদেক নামের এক রোহিঙ্গা অসুস্থ হওয়ায় তাকে রিমান্ডের অনুমতি দেননি আদালত। এই রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। তারা কেন মিয়ানমার গিয়েছিল এবং অস্ত্র নিয়ে ফিরছিল সেসব জিজ্ঞাসা করছে পুলিশ।
ক্যাম্পের বেড়া কেটে পালিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা, আটক ৪০
মিয়ানমারে সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যে কক্সবাজারের ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা; ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। গতকাল সোমবার সকালে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহন তল্লাশি চালিয়ে এক ঘণ্টায় ৪০ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে পুলিশ।
এপিবিএন-৮-এর অধিনায়ক মো. আমির জাফর বলেন, ‘ক্যাম্পে কাঁটাতার কেটে রোহিঙ্গারা দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। তাই কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে বাড়তি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। উখিয়া ডিগ্রি কলেজ এলাকার চেকপোস্ট থেকে যানবাহনে তল্লাশি চালিয়ে ৪০ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে।’ কাজের সন্ধানে এসব রোহিঙ্গা নানা উপায়ে ক্যাম্প ছাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, তারা সবাই চট্টগ্রামের পটিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করছিল। ওখানে একটি চক্র তাদের কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। চলতি মাসে ৫১১ রোহিঙ্গাকে পালানোর সময় আটক করা হয়েছে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন উখিয়া প্রতিবেদক)