চম্পক কুমার, জয়পুরহাট
প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:০৫ এএম
আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:৪১ এএম
দুই বছর ধরে ইজারা নেই তবু দিনরাত সমানতালে চলছে বালু উত্তোলন। প্রবা ফটো
কৃষক ঈসাহাক আলী নিজের ১০ শতক জমিতে গত দুই বছর আগেও চাষাবাদ করেছেন। এখন তার সেই জমির পরিমাণ এক শতকেরও কম দাঁড়িয়েছে। ৯ শতকের বেশি জমি এখন নদীগর্ভে। বালু উত্তোলনের ফলে নদী ভাঙতে ভাঙতে তার ৯ শতকের বেশি জমি নদী গিলে ফেলেছে। এখন সেই জমিটি ত্রিভুজ আকৃতি ধারণ করেছে। বর্ষা মৌসুমে এই অংশটুকুও নদীর পেটে চলে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন ওই কৃষক।
জয়পুরহাট সদর উপজেলার ভাদসা ইউনিয়নের ছোট যমুনা নদীর ছাওয়ালপাড়া ঘাট এলাকায় শুধু ঈসাহাক আলী নন, তার মতো অনেক কৃষক জমি রক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। গত ১০ বছর ওই ঘাট থেকে বালুমহাল ইজারা নিয়ে খননযন্ত্র (ড্রেজার) দিয়ে অবৈধভাবে নদীর তলদেশের বালু উত্তোলন করা হয়েছে। এতে নদীর ওই অংশের পূর্ব ও পশ্চিম দিকের প্রায় ৫০ বিঘা আবাদি জমি নদী গিলে ফেলেছে। এদিকে বালু না থাকায় গত দুই বছর ছাওয়ালপাড়া ঘাটের বালুমহাল ইজারা বন্ধ রেখেছে জেলা প্রশাসন। তবে বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি। সরকার এই বালুমহাল থেকে দুই বছরে কয়েক লাখ টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হলেও বালু উত্তোলনকারীরা লাখ লাখ টাকার বেশি বালু বিক্রি করেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ও জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সাল থেকে ছোট যমুনা নদীর ছাওয়ালপাড়া ঘাট থেকে বালু উত্তোলন শুরু হয়। প্রথমদিকে নদীর উপরিভাগে জড়ো হওয়া বালু কেটে নেওয়া হয়েছে। তখন নদী পাড়ের আবাদি জমির কোনো ক্ষতি হয়নি। ২০১৪ সালের পর থেকে নদীতে খননযন্ত্র দিয়ে দিন-রাত সমান তালে বালু তোলা শুরু হয়। এতে নদী পাড়ের আবাদি জমি ভেঙে নদীগর্ভে যেতে শুরু করে। প্রশাসনকে জানিয়েও জমির মালিকেরা সুফল পাননি। তখন বালু উত্তোলনকারীদের সঙ্গে সমঝোতা করে টাকার বিনিময় মালিকরা তাদের জমি ছেড়ে দেন। এখন যা জমি রয়েছে সেগুলোও হুমকির মুখে পড়েছে।
ছাওয়ালপাড়া ঘাট এলাকায় এর আগে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এক যুগ আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ছাত্রশিবিরের হামলায় নিহত ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেনের নামে সেতুটির নামকরণ হওয়ার ঘোষণাও হয়েছিল। কিন্তু টানা বালু উত্তোলনে নদীর গভীরতা বেড়ে যাওয়ায় বাতিল হয়ে পড়ে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ।
স্থানীয়রা জানায়, গত জানুয়ারি মাসে বালু উত্তোলন বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়। প্রশাসনের লোকজন এসে বালু উত্তোলন বন্ধ করে। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বন্ধের কয়েক দিন পর আবারও নদীর একই স্থান থেকে ড্রেজার মেশির দিয়ে বালু উত্তোলন শুরু হয়। পরে আবারও বালু উত্তোলন বন্ধে অভিযান চালানো হয়। তবে যারা বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন, এখন তারা সবাই ভয় ও আতঙ্কে রয়েছেন।
সম্প্রতি দেখা গেছে, ছাওয়ালপাড়া ঘাটে ছয় থেকে সাতটি মেসি ট্রাক্টর ভিড়েছে। নদী থেকে খননযন্ত্র দিয়ে বালু ওপরে তুলে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে ট্রাক্টরে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একজন ব্যক্তি টং ঘরে বসে বালু বিক্রির স্লিপ দিচ্ছিলেন আর হিসাব রাখছিলেন। বালু বিক্রির রসিদে ইজারাদার মামুনুর রশিদ নাম লেখা রয়েছে। নিচে মোবাইল নম্বরের ডান পাশে রাজু লেখা রয়েছে। ট্রাক্টর চালকরা জানান, প্রতি ট্রাক্টর বালু ৬০০ টাকা নিচ্ছে। গাড়ি ভাড়াসহ তারা দূরত্ব অনুযায়ী এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি করছেন।
এক ব্যক্তি নিজেকে রাজু পরিচয় দিয়ে বলেন, আমি বালু ঘাটের কর্মচারী। প্রতিদিন ৪০০ টাকা করে বেতন পাই। জয়পুরহাট পৌরসভার মেয়রের পিএস মামুনুর রশিদ আর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জাকারিয়া হোসেন রাজা বালু উত্তোলন করছেন।
যোগাযোগ করা হলে মামুনুর রশিদ ও জাকারিয়া হোসেন রাজা বলেন, আমরা ২০১৯ সালে বালুমহাল ইজারা নিয়েছিলাম। প্রশাসন আমাদের কাছে ইজারার টাকা নিয়েছে। কিন্তু আমাদের বালুমহাল বুঝিয়ে দেয়নি। বালুমহাল বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনে আবেদন করেছিলাম। তারপরও বালুমহাল বুঝে পাইনি। এ কারণে আমরা সেখানে মালামাল রেখে অবস্থান করছি। আমরা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছি না।
ভাদসা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সারওয়ার হোসেন বলেন, কে বা কারা বালু উত্তোলন করছে সেটি বলতে পারব না। জামায়াত-শিবিরের হাতে নির্মমভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত জয়পুরহাটের সন্তান ফারুকের নামে ঘাটে একটি সেতু হওয়ার কথা ছিল। তার অংশ হিসেবে নদীর কাছাকাছি পর্যন্ত রাস্তা পাকাও করা হয়েছে। কিন্তু বালু তোলার ফলে নদীর গভীরতা অনেক হয়েছে। এ কারণে সেতুটি আর হয়নি।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. সবুর আলী বলেন, জয়পুরহাট সদর উপজেলার ছাওয়ালপাড়ায় বালুমহাল ছিল। তবে এখন জয়পুরহাট সদর উপজেলায় কোনো বালুমহাল নেই। ছাওয়ালপাড়া বালুমহাল দুই বছর ধরে ইজারা বন্ধ রয়েছে।
জেলা প্রশাসক সালেহীন তানভীর গাজী বলেন, ওই ঘাটের ইজারা নেই। সেখানে অভিযান চালানো হয়। বালু উত্তোলন বন্ধ করা হচ্ছে, আবার চালু হচ্ছে। আমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছি।