সুবল বড়ুয়া, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৪:২৩ পিএম
আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৮:০০ পিএম
একেএম ফজলুল্লাহ। ফাইল ফটো
প্রজ্ঞাপনে আছে, চট্টগ্রাম ওয়াসায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে পারবেন একমাত্র মহামান্য রাষ্ট্রপতি। সেই এখতিয়ারকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে লাখ টাকা বেতনে এক কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম ফজলুল্লাহ। এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি শুধু আইনই ভঙ্গ করেননি; চুক্তিভিত্তিক মেডিকেল অফিসার নিয়োগ দিয়ে তার কাছে প্রতি মাসে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার সচিবালয় শাখার তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের ২২ জুন চট্টগ্রাম ওয়াসার মেডিকেল অফিসার ডা. মো. মোছলেহ উদ্দিন চাকরি থেকে অবসরে (এলপিআর) যান। কর্মরত ডা. মোছলেহ উদ্দিন নির্ধারিত তারিখে এলপিআরে যাবেন; বিষয়টি সামনে রেখে চার মাস আগে (২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রাম ওয়াসা সচিব শাহিদা ফাতেমা চৌধুরী একাধিক পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও দেন।
কিন্তু অদৃশ্য কারণে এই নিয়োগ কার্যকর না করে ২০২২ সালের ৬ জুলাই অবসরে যাওয়া ডা. মোছলেহ উদ্দিনকে সংস্থাটির ৬৮তম সাধারণ বোর্ডসভায় একটি প্রস্তাব পাস করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হয়।
২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রবিধানমালা নিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সেই প্রজ্ঞাপনের ৬২ অনুচ্ছেদের অবসরগ্রহণসংক্রান্ত আইনে বলা আছেÑ অবসরগ্রহণ এবং উহার পর পুনঃনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীসংক্রান্ত চাকরি আইন, ২০১৮ সালের ৫৭নং আইনের ৪৯নং অনুচ্ছেদের অবসরগ্রহণকারী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ-(১) রাষ্ট্রপতি, জনস্বার্থে কোনো কর্মচারীকে চাকরি হতে অবসরগ্রহণের পর, সরকারি চাকরিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করিতে পারিবেন। এ ছাড়াও ওয়াসা ১৯৯৬ অধ্যাদেশের ৩০ অনুচ্ছেদেও বলা আছেÑ কোনো কর্মচারীকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রবিধা দ্বারা পরিচালিত হবে মর্মে উল্লেখ আছে।
অর্থাৎ এসব আইন ও প্রবিধানমালা অনুযায়ী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের এখতিয়ার একমাত্র মহামান্য রাষ্ট্রপতির। কিন্তু এই বিধানভঙ্গ করে ডা. মোছলেহ উদ্দিনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। শুধু তাই নয়, অবসরে যাওয়ার আগ মুহূর্তেও তিনি ওয়াসার মেডিকেল অফিসার পদে বেতন পেতেন ৮৮ হাজার টাকা।
কিন্তু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সময়ও পূর্বের বেতনের চেয়ে বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫০০ টাকা। অথচ মেডিকেল অফিসারের পদটি নবম গ্রেডের। জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী নবম গ্রেডের বেতন ২২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫৩ হাজার ৬০ টাকা। সেই হিসাব অনুযায়ী দ্বিগুণ বেতন দিয়ে এই মেডিকেল অফিসারকে অনৈতিকভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে উঠে এসেছে।
এই অভিযোগ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি একা নিয়োগ দিইনি। ওয়াসার বোর্ডসভা অনুমোদন দিয়েছে। যেহেতু এখনও মেডিকেল অফিসার নিয়োগ হয়নি; তাই তিনি বহাল রয়েছেন।’
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েও নিয়োগ করা হচ্ছে না কেনÑ এমন প্রশ্নে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে যিনি দায়িত্বে আছেন, তাকে বৈধভাবেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’
তবে ২০২২ সালের ৬ জুলাই অবসরে যাওয়া ডা. মোছলেহ উদ্দিনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়টি সংস্থাটির ৬৮তম সাধারণ বোর্ডসভায় পাস করার সময় এসব প্রবিধানমালার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার এক বোর্ড মেম্বার। তিনি বলেন, ‘যেহেতু মেডিকেল অফিসার পদে থাকা ব্যক্তি এলপিআরে যাবেন, তাই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়েছে। সেখানে আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগটি প্রশ্নবিদ্ধ। এমডি তার নিজের স্বার্থে এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছেন। তা না হলে নিয়োগ দেওয়ার সময় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিষয়টি কেন সভায় জানানো হয়নি। এ ছাড়া প্রায় দুই বছরেও কেন এই নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।
তবে এলপিআরে যাওয়ার পর নবম গ্রেডের পদে মনগড়া চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়াকে সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূত বলে মন্তব্য করেছেন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডির স্বচ্ছতা ও কার্যক্রম আমাদের সবারই জানা। উনার খুটির জোর কোথায়, আমাদের জানা দরকার। এত অন্যায়-দুর্নীতি করার পরও কীভাবে বহাল তবিয়তে আছেন? তিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে পারেন না। আইনভঙ্গ করে নিয়োগ দেওয়া মানে নিশ্চয়ই আর্থিক লেনদেন হয়েছে। না হলে আইনভঙ্গ করে নিয়োগ দিতেন না। ওয়াসায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।’
ডা. মোছলেহ উদ্দিনকে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পক্ষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া নিয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার বর্তমান সচিব শাহিদা ফাতেমা চৌধুরীর বক্তব্য জানতে গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম ওয়াসা কার্যালয়ে গিয়ে বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।