× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বাবা-মায়ের কাছে শিশু মারুফের শেষ কথা

‘আমাকে না নিয়ে গেলে নির্যাতনে মইরা যামু’

সাইফ বাবলু

প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:২৬ এএম

আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:৪৬ এএম

শিশু মারুফ। ছবি : সংগৃহীত

শিশু মারুফ। ছবি : সংগৃহীত

ডাকাতির মামলায় ১৪ বছরের শিশু মারুফকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ আদালতে পাঠায়। বয়স কম হওয়ায় ওই শিশুকে আদালত গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত কিশোর সংশোধনাগারে (শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র) পাঠান। ১৭ দিনের মাথায় ওই শিশুর মৃত্যু হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শিশুটির পরিবারের অভিযোগ, টঙ্গীর কিশোর সংশোধনাগারে নির্যাতনের কারণে মারুফের মৃত্যু হয়েছে। সংশোধনাগারে বাবা-মা দেখা করতে গেলে শিশু মারুফের শেষ কথা ছিলÑ ‘আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও, ওরা আমাকে দিয়ে বাথরুম ধোয়ায়, না ধুইতে চাইলে মারধর করে। আমাকে এখান থেকে না নিয়ে গেলে আমি নির্যাতনে মইরা যামু।’

বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় মারুফ। সে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের রফিক মিয়ার ছেলে। পরিবারের সঙ্গে মারুফ খিলক্ষেত এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকত। চার ভাইবোনের মধ্যে মারুফ ছিল সবার বড়। ছেলের এমন ‍মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন বাবা রফিক মিয়া ও মা জেসমিন বেগম। ছেলের এমন মর্মান্তিক মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না বাবা-মা। ছেলের লাশের ওপর বুকফাটা আর্তনাদে মা জেসমিনের প্রশ্ন, ‘কী অপরাধ ছিল আমার ছোঁড়াডার?’ আর বাবা মিজান মিয়া বলেন, ‘পাঁচ দিন ধইরা আমার পোলার কথাবার্তা বন্ধ ছিল। তারা ঠিকমতো চিকিৎসাও করায়নি। হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে রাখা হয়েছিল। হ্যান্ডকাপ খুলতে বললেও খোলে নাই। মারা যাওয়ার পর হ্যান্ডকাপ খুলছে।’ 

মারুফের মামা সোহাগ মিয়া প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, তার ভাগিনা মারুফ সিলেটে একটি মাদ্রাসায় কুরআনে হাফেজ হওয়ার জন্য ভর্তি হয়েছিল। অভাব-অনটনের কারণে দুই বছর আগে সেই মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা ছেড়ে চলে আসে। খিলক্ষেত আসার পর স্থানীয় একটি চায়ের দোকানে কাজ নেয়। পাশাপাশি কাঁচা তরিতরকারি ভ্যানে ওঠানো-নামানোর কাজ করত। গত ২৭ জানুয়ারি একটি ভ্যান থেকে মালামাল নামানোর পর ক্ষুধা লাগলে পাশে একটি দোকানে ঝালমুড়ি খেতে যায়। ওই সময় স্থানীয় দুই বখাটের সঙ্গে ঝালমুড়ির দোকানদারের সঙ্গে মারামারি হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে ওই দুই বখাটেকে আটক করে। এ সময় মারুফকে তাদের সঙ্গের লোক বলে ধরে নিয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, খবর পেয়ে মারুফের বাবা থানায় গেলে পুলিশ বলে, মারামারির সঙ্গে মারুফ জড়িত। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আদালত থেকে ছাড়িয়ে আনতে হবে। পরদিন আদালতে গিয়ে উকিল ধরেন মারুফের জামিনের জন্য। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, মারুফকে ডাকাতির মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়েছে খিলক্ষেত থানার পুলিশ। ওই কারণে জামিন হয়নি। পরে মারুফের বয়স কম হওয়ায় তাকে টঙ্গীতে কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়। সেখানে মারুফের ওপর নির্যাতন চালায় কিশোর সংশোধানগার কেন্দ্রের লোকজন। 

সোহাগ মিয়া বলেন, ‘তারা কেমন পাষণ্ড যে পোলাডার জবান বন্দ হয়ে গেলেও হ্যান্ডকাপ পরিয়ে রাখা হয়েছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও হ্যান্ডকাপ লাগানো ছিল। দম (মারা যাওয়া) বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তারা হ্যান্ডকাপ খুলেছে।’

মারুফের বাবা মিজান মিয়া প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, দিনমজুরের কাজ করেন তিনি। তার ছেলে খারাপ কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল না। অন্য দুই টোকাই ছেলের সঙ্গে ঝালমুড়ির ব্যবসায়ীর মারামারি হয়েছে। মারুফ তাদের চেনেও না। কিন্তু পুলিশ ওই বখাটেদের সঙ্গে লোক মনে করে মারুফকে থানায় নিয়ে যায়। হয়েছে মারামারির ঘটনা। আর তার ছেলের নামে দেওয়া হয়েছে ডাকাতির মামলা। ছেলেকে টঙ্গীতে পাঠানোর পর তারা দেখা করতে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, তার ছেলেকে মারধর করা হয়। 

তিনি বলেন, ‘আমি মারুফের মাকে (জেসমিন) নিয়ে গাজীপুরের টঙ্গীতে কিশোর সংশোধনাগার কেন্দ্রে দেখা করতে যাই। সেখানে ছেলের কাছে জানতে পারি, ওই সংশোধনাগার কেন্দ্রে ছেলেকে দিয়ে বাথরুম ও রান্নার কাজে ব্যবহৃত হাঁড়িপাতিল ধোয়াতো। কাজ না করতে চাইলে বেধড়ক মারধর করা হতো। নির্যাতনের এসব কথা জানিয়ে মারুফ সেখান থেকে তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য আকুতিও জানিয়েছিল আমাদের কাছে। বলেছে, আমি জীবনেও কারও সঙ্গে ঝগড়া করুম না। তোমরা আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও, না হলে আমি মইরা যামু।’

বুকফাটা আর্তনাদে রফিক মিয়া বলেন, কয়েক দিন পরই ওই সংশোধনাগার কেন্দ্র থেকে ফোন করে জানানো হয়, আমার ছেলে অসুস্থ। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। থানা থেকেও ফোন করে আমার ছেলেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার কথা জানানো হয়। হাসপাতালে এসে দেখি ছেলে আর দুনিয়ায় নেই। ওর লাশ পড়ে আছে। 

পরিবারের অভিযোগ ঢাকা মেডিকেলে মারুফকে যেদিন অসুস্থ হওয়ার কথা বলে আনা হয়েছে, তার এক দিন পর পরিবারকে জানানো হয়। ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে মারুফের শরীরে নির্যাতনের নানা চিহ্ন দেখতে পায় পরিবার। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হওয়াসহ শরীরের নানা চিহ্ন ভয়াবহ নির্যাতনের কারণে বলে অভিযোগ তাদের। 

মারুফের মা জেসমিন বেগম আর্তনাদ করতে করতে বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলে এসে দেখি আমার ছেরাডার নিথর দেহ। ওর চোখ বন্ধ, মুখেও কোনো কথা কয় না। আমার ছেরাডার শরীরে, হাতের কনুইয়ে ও পিঠের বিভিন্ন জায়গায় মাইরের দাগ আছে। আমার ছেরাডা তো ছোট, ও তো এভাবে মইরা যাইতে পারে না। হাসপাতলে ওর বিছানার সামনে গিয়া দেহি, ওর নাক-মুখ দিয়া খালি রক্ত বাইর হইতাছে। ওই গাজীপুরের হেরাই মাইরধর কইরা আমার ছেরাডারে মারছে।’ 

ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ মো. বাচ্চু মিয়া জানান, গত ৯ ফেব্রুয়ারি বিকালের দিকে গাজীপুরের শিশু সংশোধনাগার কেন্দ্র থেকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় শিশু মারুফকে জরুরি বিভাগে আনা হয়। পরে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। সেখানেই মারুফের চিকিৎসা চলছিল। বুধবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সে। মরদেহ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশকে জানানো হয়েছে।

মারামারির ঘটনায় আটক করে ডাকাতির মামলা দেওয়ার বিষয়ে জানতে খিলক্ষেত থানার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। একাধিকবার ফোন করা হলেও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফোন ধরেননি। 

অভিযোগের বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রতিষ্ঠান-২) মোহাম্মদ রেজাউর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ওই শিশু গত শনিবার জ্বর ও ভাইরাসে আক্রান্ত হয় বলে কিশোর সংশোধনাগারের তত্ত্বাবধায়ক আমাদের জানিয়েছেন। ওই সময় সে বেশ অস্বাভাবিক আচরণও করেছিল। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শিশুটি আগে মাদকাসক্ত ছিল। অসুস্থ হওয়ার পর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়, সেখানে সে মারা যায়। সেখানে মূলত জ্বর ও ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে চিকিৎসকরা আমাদের জানিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, ওই শিশুর মরদেহ ময়নাতদন্তের পর প্রতিষ্ঠান তত্ত্বাবধায়ক আমাদের কাছে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন দেবেন। সেখানে কোনো অসংগতি চোখে পড়লে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তদন্ত করা হবে। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা