সাইদুর রহমান আসাদ, সুনামগঞ্জ
প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৩:২২ পিএম
আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৩:২৪ পিএম
ফাগুনের হাওয়ায় শিমুল বাগানের সবুজের ডালে ডালে রক্ত লালের নাচন। মঙ্গলবার সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে। প্রবা ফটো
‘নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল,/বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল।’ কবিগুরুর প্রকৃতি পর্যায়ের এ গানের ছবি যেন ফুটে উঠেছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের শিমুল বাগানে। সেখানেও চতুর্দিকে নীলদিগন্তে রক্তরাঙা লাল ফুল। বসন্তের আগমনে ফুলে ফুলে ভরে গেছে। আর এতেই ভিড় করছেন দর্শনার্থীরা। এখানেই বসন্ত বরণ করে নিতে উৎসবের আয়োজন করেছে জেলা শিল্পকলা একাডেমিও।
বাগানে এখন সবুজের ডালে ডালে রক্ত লালের নাচন। শতকোটি শিমুল ফুলের রাজত্ব, এ যেন এক ফুলের স্বর্গরাজ্য। উত্তরের মেঘালয়-খাসিয়া পাহাড় থেকে জাদুকাটার জল ছুঁয়ে দোল খাচ্ছে শিমুল ফুলের গাছে। সে হাওয়ায় ঝরে পড়ছে রক্তরাঙা লাল শিমুল ফুল। তাই পাহাড়ি নদী জাদুকাটার তীরজুড়ে এখন শুধুই মুগ্ধতা। রক্তরাঙা শিমুল বাসন্তী অভিবাদন জানাচ্ছে সবাইকে। দেখে মনে হয় ফাগুনের প্রকৃতির এই আগুনের সূত্রপাত বুঝি এই শিমুল বাগান থেকেই। রূপের সেই ছটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। হরণ করছে হাজারো ভ্রমণ ও সৌন্দর্যপিপাসুর মন।
জামালগঞ্জ থেকে হোসাইন আহমদ বিপ্লব বললেন, ‘যাদুকাটা নদীর তীরবর্তী এই শিমুল বাগান। বাগানে ফুটেছে টকটকে লাল ফুল। এই ফুল দেখলে ছন্নছাড়া মানুষও প্রেমিক হয়ে যায়। বাগানের সৌন্দর্য মানুষ দূরদূরান্ত থেকে দেখতে আসে। তেমনি আমরাও এসেছি দলবলে।’
লিপি আক্তার নামে আরেক দর্শনার্থী বলেন, দেশের বৃহত্তম শিমুল বাগানে ঘুরতে এসেছি। অবশ্য প্রতিবারই আসা হয়। এখন সব গাছেই ফুল ফুটতে শুরু করেছে। খুব ভালো লাগছে। ভারতের মেঘালয় পাহাড়, বড়গোপটিলা ও রূপের নদী যাদুকাটার সমন্বয়ে শিমুল বাগানের সৌন্দর্য যেন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।’
নোয়াখালী থেকে এসেছেন মোয়াজ্জেম হোসেন সবুজ। তিনি বলেন, পরিবার নিয়ে শিমুল বাগানে এবারই প্রথম আসা। ছবিতে দেখেছি, বাস্তবে তার চেয়েও সুন্দর। এখানে এসে আমাদের সবার মন ভালো হয়ে গেছে।’
বাগানে ফুল ঝরে লালগালিচা হয়েছে। অতিথিদের লালগালিচায় স্বাগত জানান ফুল বিক্রতা, ঘোড়াচালকসহ ফটোগ্রাফাররা। লালগালিচার ফুল কুড়িয়ে তৈরি হচ্ছে মালা, বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। রূপকথার ঘোড়ার পিঠে চড়ে দর্শনার্থীরা লালগালিচায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আবার তাদের স্মৃতিও স্থায়ীভাবে ধারণ করে নিচ্ছেন।
যাদুকাটা নদীর তীরে ১০০ বিঘারও বেশি জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছে এই শিমুল বাগান। শীতের বিদায়ের এই সময়ে, একসঙ্গে তিন হাজার গাছ পাপড়ি মেলে মধুর বসন্তকে বরণ করে নিয়েছে। একদিকে রক্তিম ফুলের আভা, অন্যদিকে ভ্রমণপিপাসু মানুষ। সব মিলিয়ে যেন এক উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে।
বাগানের শুরুটা আজ থেকে একুশ বছর আগে। ২০০৩ সালে উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রয়াত জয়নাল আবেদীন পতিত জমিতে গড়ে তোলেন এই বাগান। তিনি না থাকলেও থেমে নেই প্রকৃতিপ্রেমী মানুষটির স্বপ্ন।
জয়নাল আবেদীনের ছেলে রাকাব উদ্দিন বললেন, বাবা ছিলেন বৃক্ষপ্রেমী। টাঙ্গুয়ার হাওরে তিনি নিজ হাতে প্রায় ৯০ হাজার গাছের চারা রোপণ করেছিলেন। আজ যেখানে শিমুল বাগান হয়েছে, সেই জায়গাটা একসময় পতিত ছিল। সেখানে তিনি দেখতে পান তিনটি ছোট ছোট শিমুলগাছ। সেই থেকেই পরিকল্পনা। পরে জায়গা কিনে শিমুলগাছ রোপণ করেছিলেন। ২০০৬ সালে বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাবার স্বপ্ন ছিল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তুলা উৎপাদন করার। এতে মানুষের কর্মসংস্থান বেড়ে যাবে। এখন সেটি পর্যটক এলাকা হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। বাবা বেঁচে না থাকলেও, তার স্বপ্ন আজও বেঁচে রয়েছে শিমুল বাগানে।’
দেশের বৃহৎ এই শিমুল বাগানে ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করে নেওয়ার জন্য উৎসবের আয়োজন করেছে জেলা শিল্পকলা একাডেমি। আজ দিনব্যাপী কবিতা, নৃত্য ও গানের বন্দনার মধ্য দিয়ে চলবে আয়োজন। বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা কালচারাল অফিসার আহমেদ মঞ্জুরুল হক চৌধুরী বলেন, শিল্প সংস্কৃতির উর্বর ভূমি সুনামগঞ্জে শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে বসন্তবরণ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। উৎসবে ১২টি নৃত্যের দল, ধামাইল, রবীন্দ্র সংগীত, দলীয় সংগীতসহ বাউল দলের পরিবেশনা রয়েছে।’