ইসমাইল হোসেন লিটন, শরণখোলা (বাগেরহাট)
প্রকাশ : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:১৩ এএম
আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:২২ এএম
খান শফিউল্লাহ খোকন। ছবি : সংগৃহীত
খুলনার রূপসা উপজেলার দেয়ারা এলাকার বাসিন্দা খান শফিউল্লাহ খোকন (৭৩) ওরফে ‘রাজাকার খোকন’। চার দশকে হয়ে উঠেছেন পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার চরের মৎস্যপল্লীর অঘোষিত সম্রাট। প্রভাব আর আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে নিরীহ জেলেদের শাসন ও শোষণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অর্থবিত্তে ফুলেফেঁপে উঠেছেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে দুবলার চরের সেই দাপুটে মৎস্য ব্যবসায়ীর দুই সপ্তাহ ধরে কোনো খোঁজ মিলছে না। আত্মগোপনে চলে গেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে করা যুদ্ধাপরাধ মামলার তদন্ত শুরু হওয়ায় দুবলার চর ছেড়ে পালিয়েছেন খোকন।
জানা গেছে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় খোকন রূপসা (সাবেক খুলনা) থানার দেয়ারা এলাকার রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর পালিয়ে যান ভারতে। দুই বছর পর দেশে ফিরে স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করেন। তবে একই এলাকার সাইদ মল্লিক নামে একজন মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাবা শামসুর রহমান ওরফে শ্যাম মল্লিককে গুলি করে হত্যার অভিযোগে খোকনের নামে মামলা করেন। ২০২২ সালে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই মামলা করেন তিনি। সম্প্রতি এই মামলার তদন্ত শুরু হলে খোকন আত্মগোপনে চলে যান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুবলার চর ও আলোরকোলের একাধিক জেলে-মহাজন জানান, ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে রাজাকার পরিচয় গোপন করে শফিউল্লাহ খোকন বঙ্গোপসাগরের মোহনায় শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার চরে মাছের ব্যবসা শুরু করেন। এরপর থেকেই আবার তার স্বরূপ উন্মোচিত হয়। শুরু করেন নিরীহ জেলেদের নির্যাতন আর শোষণ। সেই থেকে প্রায় চার দশক ধরে খান শফিউল্লাহ খোকন ওরফে ‘রাজাকার খোকন’ দুবলার চরের মুকুটহীন সম্রাট বনে যান। হয়ে ওঠেন গোটা বঙ্গোপসাগর এবং সুন্দরবনের দুবলার চরের মৎস্যপল্লীর নিয়ন্ত্রক। কিন্তু সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী খোকন হঠাৎ করে চলে গেছেন আত্মগোপনে। গত দুই সপ্তাহ ধরে দুবলার চরে দেখা যাচ্ছে না তাকে। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
খান শফিউল্লাহ খোকন দুবলার চর ছেড়ে পালানোর খবরে জেলে ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। দুবলার চরের জেলে-মহাজনরা এতদিন তার কাছে জিম্মি ছিলেন। নিরীহ জেলে-ব্যবসায়ীরা অনেকেই তার হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, খান সফিউল্লাহ খোকন রূপসার দেয়ারা গ্রামের খান শহিদুল্লার ছেলে। ছাত্রজীবনে তিনি ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফ্রন্টের (এনএসএফ) সক্রিয় কর্মী ছিলেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে খুলনার মুসলিম লীগের নেতা খান এ সবুরের পেটোয়াবাহিনীর প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর পরই ভারতে পালিয়ে যান। দুই বছর পরে আবার দেশে ফেরেনে। নিজ গ্রাম দেয়ারায় বসবাস শুরু করেন।
যুদ্ধাপরাধ মামলার বাদী সাইদ মল্লিক বলেন, মুক্তিযুদ্ধেরের সময় ভাদ্র মাসের ২৯ তারিখ রাতে খোকন রাজাকার এবং তার সহযোগী আমজাদ ও নিয়ামত মুন্সী আমার বাবাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেন। পরে ২০২২ সালে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে খোকন রাজাকার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করি। সেই মামলার তদন্ত শুরু হয়েছে। গত ২৫ জানুয়ারি তদন্তকারী কর্মকর্তারা রূপসা থানায় এসে সাক্ষ্যগ্রহণ করেন। মূলত খোকনের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া যুদ্ধাপরাধ মামলার তদন্ত শুরু হওয়ার পর পরই দুবলার চর ছেড়ে পালিয়ে যান খোকন রাজাকার। মামলার আগে ও পরে খোকন এবং তার লোকজন আমাকে হত্যাসহ মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দিয়েছেন।
যুদ্ধাপরাধ মামলার সাক্ষী মুনসুর আলী শেখ (৭২) বলেন, রাজাকারের কমান্ডার খোকন ও তার লোকজন আমার ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল শেখ ও শামসুর রহমান ওরফে শ্যাম মল্লিককে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের দুজনকে গুলি করার পর শ্যাম মল্লিক ঘটনাস্থলেই মারা যান।পরে আমার ভাইকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে খুলনায় নিয়ে চিকিৎসা করানোর পর বেঁচে যান।
সাক্ষী মুনসুর শেখ আরও বলেন, ১৯৭১ সালে খোকন রাজাকারের নেতৃত্বে শোলপুর, দেয়ারা ও যুগীহাটি গ্রামে হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, লুটপাট, হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ খুলনা জেলা ইউনিটের কমান্ডার মো. মাহাবুবার রহমান বলেন, খান শফিউল্লাহ খোকন একজন তালিকাভুক্ত রাজাকার। বাবার নাম অস্পষ্ট থাকায় প্রথম দিকে তার নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ে। পরে সংসদীয় কমিটি থেকে তালিকা চাওয়া হলে বাবার নাম শনাক্ত করে খোকনকে রাজাকারের তালিকাভুক্ত করা হয়। ১৯৭১ সালে তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন, হত্যা, লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে।
খান শফিউল্লাহ খোকন আত্মগোপনে থাকায় এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তার ফোন নম্বরও বন্ধ পাওয়া গেছে।