প্রত্ননিদর্শন
সাইফুল হক মোল্লা দুলু, মধ্যাঞ্চল
প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:৪৪ এএম
কিশোরগঞ্জের পূর্ব-দক্ষিণে পাকুন্দিয়া উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরে এগারসিন্দুর দুর্গের ষষ্ঠ ধাপের খননের পর দুর্গের ধাপযুক্ত স্থাপনা দেখতে মানুষের ভিড়। নিচে খননের সময় পাওয়া বিভিন্ন প্রত্ননিদর্শন। বৃহস্পতিবার তোলা। প্রবা ফটো
ঈশা খাঁর যুদ্ধক্ষেত্র এগারসিন্দুর দুর্গ দেখতে মানুষের ভিড় বাড়ছে দিন দিন। প্রায় দুই বছর আগে খননের পর এখানে বিভিন্ন প্রত্ননিদর্শন আবিষ্কৃত হওয়ায় শিক্ষার্থীসহ নানা পেশার মানুষ আসছে। তাদের পদভারে মুখর হয়ে উঠছে এগারসিন্দুরের দুর্গ এলাকা।
কিশোরগঞ্জের পূর্ব-দক্ষিণে পাকুন্দিয়া উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরে এগারসিন্ধুর দুর্গ। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বারো ভূঁইয়াদের নেতা ঈসা খাঁ মোগলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই দুর্গ ব্যবহার করেন। মোগল বাদশা আকবরের বাংলা জয়ের সময় এই দুর্গে আক্রমণ করেন তার সেনাপতি মানসিংহ। ইতিহাসের সাক্ষী দুর্গটির অস্তিত্ব অনেক আগেই বিলীন হয়ে রূপ নিয়েছিল ঢিবিতে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খননকারীরা এই ঢিবি খুঁড়ে পেয়েছে আরেক ইতিহাসÑ ধাপযুক্ত স্থাপনা, যাকে বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসের এক বিরল নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা।
খননে দুর্গ এলাকায় আড়াই শতাধিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ধাপযুক্ত স্থাপনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। একে বাংলার ইতিহাসের প্রাক-মুসলিম (১২০৪ সালের আগের সময়) স্থাপত্য কাঠামোর স্বতন্ত্র ও আলাদা গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে দেখা হচ্ছে। এখানে খননকাজে নেতৃত্ব দেন তৎকালীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক গোলাম ফেরদৌস। এই স্থাপনাটিকে অতি বিরল আখ্যায়িত করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ২০১২ সালে নরসিংদীর ওয়ারী বটেশ্বরে ধাপযুক্ত স্থাপনার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল বটে, তবে সেটি খুবই ছোট পরিসরের। এগারসিন্দুর দুর্গে যেটি মিলেছে সেটি উল্লেখ করার মতো। সমতল ভূমিতে এমন স্থাপনা এর আগে আর পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, এটি প্রাচীন আধিবাসীদের ব্যবহৃত সামাজিক কিংবা ধর্মীয় কোনো প্রতিষ্ঠান হতে পারে। প্রকৃত ব্যবহারিক উদ্দেশ্য জানতে আরও অনেক গবেষণা প্রয়োজন। খনন-উত্তর গবেষণার মাধ্যমে এসব প্রশ্নের উত্তর বের করা হবে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এ ধরনের স্থাপনা নির্মাণের কারণ অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছেন, সেকালে এ অঞ্চলের ভূমি ছিল ঢালু ও অমসৃণ। মাটির এমন বৈশিষ্ট্যের কারণেই এ ধরনের স্থাপনা গড়ে তোলা হতে পারে। এক কথায়, ভৌত স্থাপনার সঙ্গে ভূমিরূপের সামঞ্জস্য বিধান করতেই এ ধরনের স্থাপত্য পরিকল্পনা বেছে নেওয়া হয়। এছাড়া প্রত্নতাত্ত্বিকরা নিশ্চিত করেছেন, দুর্গটি ঈসা খাঁ নির্মাণ করেননি। আগে নির্মিত স্থাপনা ঈসা খাঁ দখলে নিয়ে সামরিক ঘাঁটিতে রূপ দেন। ধাপযুক্ত স্থাপনা আবিষ্কৃত হওয়ায় বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে।
সেই সঙ্গে দুর্গে সন্ধান মিলেছে একটি তোপ মঞ্চের। ধারণা করা হচ্ছে, ঈসা খাঁর সৈনিকেরা মঞ্চটি ব্যবহার করে কামান থেকে গোলা ছুড়তেন। তোপ মঞ্চটির অবস্থান সমতল থেকে ৯ মিটার উচ্চতায়। দুর্গটি ঘিরে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকায় এলাকাবাসী এখানে একটি প্রত্নজাদুঘর নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন। পাকুন্দিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রেনু বলেন, ‘এখানে যেসব বিরল প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে তা সংরক্ষণ করা জরুরি। প্রতিদিন অনেক মানুষ এসব দেখতে আসে। কিন্তু তারা নিদর্শনগুলো দেখতে পায় না। এখানে একটি জাদুঘরে এগুলো সংরক্ষিত হলে সাধারণ মানুষ দেখতে পারবে।’