নীলফামারীতে ট্রিপল মার্ডার
নীলফামারী প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৯:০১ পিএম
আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২১:৪১ পিএম
মরদেহ দেখতে স্থানীয়রা ব্যবসায়ী আশিকুর রহমানের বাড়িতে ভিড় করেছে। প্রবা ফটো
নীলফামারীতে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে শ্বাসরোধে হত্যার পর গলা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে আশিকুর রহমান বাবু মোল্লা নামের এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। শুক্রবার (২ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সদর উপজেলার চড়াইখোলা ইউনিয়নের দারোয়ানী পুরাতন বন্দর বাজার গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। কেন এমন ঘটনা ঘটল– তার কিছুই বুঝতে পারছেন না স্বজনরা। তারা বলছেন, ব্যবসা ও শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন আশিকুর রহমান। এ কারণে এমন কিছু হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নিহতরা হলেন—আশিকুর রহমান বাবু মোল্লার স্ত্রী তহুরা বেগম, তাদের দুই শিশুমেয়ে আয়েশা আক্তার তানিয়া ও জারিন। আশিকুর রহমান চড়াইখোলা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ মোল্লার ছেলে। স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে দারোয়ানী পুরাতন বন্দর বাজার গ্রামের নিজ বাড়িতে বাস করতেন। বাড়ির সঙ্গে ‘স’ মিলসহ তামাক, পাট ও রসুন ব্যবসা করতেন আশিকুর।
নীলফামারী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. তানভিরুল ইসলাম এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
স্থানীয়রা জানান, সকালে বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে আশিকুরকে পড়ে থাকতে দেখে এগিয়ে যান প্রতিবেশী বিউটি বেগম। এ সময় তাকে গলাকাটা অবস্থায় দেখতে পেয়ে বিউটি বেগম চিৎকার দিলে অন্য প্রতিবেশীসহ বাজারের লোকজন ছুটে আসে বাড়ির ভেতরে। তখন তারা দেখতে পায় আশিকুরের স্ত্রী ও দুই মেয়ে বিছানায় মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। পরে তারা পুলিশে খবর দেয়। স্থানীয়রা আশিকুরকে উদ্ধার করে নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পরে পুলিশ এসে নিহত তহুরা বেগম এবং তার দুই শিশুমেয়ে আয়েশা আক্তার তানিয়া ও জারিনের মরদেহ উদ্ধার করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী বিউটি বেগম বলেন, ‘আশিকুর ভাইদের বাড়ি পার হয়ে সকালে কাপড় শুকাতে দিতে গেছিলাম। ফেরার পথে দেখি আশিকুর ভাই বাড়ির দরজার সমানে পড়ে রয়েছেন। আমি দৌড়ে বাড়ির ভেতরে গিয়ে ভাবি ও তার বাচ্চাদের ডাকাডাকি করি। কিন্তু তাদের কোনো সাড়াশব্দ না পাওয়ায় বারান্দার দিকে এগিয়ে গিয়ে রক্ত দেখতে পাই। এরপর দেখি আশিকুর ভাইয়ের গলা দিয়ে রক্ত ঝরছে। এ সময় আমি চিৎকার দিলে আশপাশের লোকজন আশিকুর ভাইকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং বাড়ির থাকার ঘরের বিছানায় তহুরা ভাবি ও তার দুই মেয়েকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়।’
আশিকুরের ছোট বোন সাথী আক্তার বলেন, ‘ভাইয়া ছয় মাস ধরে কিডনিতে সমস্যা নিয়ে অসুস্থ ছিলেন। শ্বশুরবাড়ি থেকে আমি প্রতি সপ্তাহে এসে ভাইয়ার খোঁজখবর নিয়ে যেতাম। গতকাল ভাবির সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। ভাবি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল কখন আসবে। আমি ভাবিকে বলেছিলাম শুক্রবার সকালে যাব। এই বলে কথা শেষ করেছি ভাবির সঙ্গে। আজ সকালে ফোনে খবর পাই ভাবি ও আমার দুই ভাতিজি আর বেঁচে নেই। ভাইয়াকে গলাকাটা অবস্থায় রংপুরে নেওয়া হয়েছে। এরপর এখানে এসে লোকজনের কাছে শুনি– ভাবি ও তার দুই মেয়েকে গলা কেটে হত্যা করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন ভাইয়া। কী কারণে এবং কেন এমন ঘটনা ঘটালো তার কোনো কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছি না।’
আশিকুরের চাচাতো ভাই জাকির হোসেন মোল্লা বলেন, ‘সকালে আমাকে একজন ফোন দিয়ে জানায় আশিকুর ভাই অসুস্থ। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমি চলে আসি। এসে দেখি ভাইকে ভ্যানে উঠানো হচ্ছে। এ সময় তার গলা দিয়ে রক্ত ঝরছে। আমাদের আরেক চাচাতো ভাইকে সঙ্গে দিয়ে তাকে দ্রুত নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর সেখান থেকে রংপুরে পাঠানো হয়। এরপর ভাবি ও তাদের দুই মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে ঘরে গিয়ে দেখি বিছানায় মৃত অবস্থায় তারা পড়ে রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আশিকুর ভাই স-মিলের ব্যবসার পাশাপাশি রসুন, পাট, তামাকের স্টোক ব্যবসা করতেন। এবার তিনি রসুন, পাট ও তামাক ক্রয় করে ব্যবসায় লস করেছেন প্রচুর টাকা। ব্যবসায় আর্থিক লসের পাশাপাশি ব্যাংকে ঋণ ছিল তার। পাশাপাশি তিনি দীর্ঘদিন থেকে কিডনি রোগে আক্রান্ত ছিলেন। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তের পাশাপাশি অসুস্থতার কারণে তিনি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমরা পরিবারের সদস্যরা তাকে নিশ্চিত করেছিলাম– ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই আমরা অর্থের সংস্থান করে তার সমস্যা সমাধান করব। এরই মধ্যে এমন অঘটন ঘটিয়ে বসল আমাদের ভাই।’
নিহত তহুরা বেগমের বাবা আব্দুল আলীম বলেন, ‘গতকাল এশার নামাজের পর মেয়ের সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়েছিল। জামাই আগের থেকে একটু সুস্থ আছে, নাতনিরাও ভালো আছে বলে জানিয়েছিল আমার মেয়ে তহুরা। এরপর আজ সকালে ফোনে খবর পাই আমার মেয়ে তহুরা এবং তার দুই মেয়েকে মেরে ফেলে নিজের গলা কেটে মরার চেষ্টা করেছে জামাই।’
নীলফামারী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. তানভিরুল ইসলাম বলেন, ‘গৃহবধূ ও তার দুই শিশুর মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠিয়েছি। শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে কি-না, সেটি ময়নাতদেন্তর প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার নিশ্চিত হওয়া যাবে। হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে থানা-পুলিশের পাশাপাশি পিবিআই ও সিআইডি কাজ করছে।’