মাতৃভাষা
সাদিকুর রহমান সামু, কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার)
প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:৫৭ এএম
আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:০৮ এএম
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের দেওড়াছড়া চা- বাগানের বামনবিল টিলায় আপন ওঁরাং ও মিঠুন ওঁরাংয়ের প্রচেষ্টায় নিজেদের বিপন্ন মাতৃভাষা ‘কুরুখ’ ভাষা শিখছে ওঁরাং সম্প্রদায়ের শিশু-কিশোররা। প্রবা ফটো
চা-বাগানেই জন্ম আপন ওঁরাং ও মিঠুন ওঁরাংয়ের। নিজেদের বিপন্ন মাতৃভাষা ‘কুরুখ’ ভাষা রক্ষায় সংগ্রাম করে চলেছেন এই দুই চা-শ্রমিক সন্তান। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার দেওড়াছড়া চা-বাগানের বামনবিল টিলায় গত এক বছর ধরে খোলা উঠানে নিজেদের সম্প্রদায়ের শিশু-কিশোরদের ‘কুরুখ’ ভাষা শিক্ষা দিচ্ছেন তারা। সপ্তাহের প্রতি শুক্র ও শনিবার ওই দুই তরুণ তাদের কুরুখ ভাষা শিক্ষাকেন্দ্রে স্বেচ্ছাশ্রমে ওঁরাং জাতিসত্তার সন্তানদের শিক্ষাদান করেন কুরুখ ভাষায়। সহভাষা হিসেবে শিখিয়ে থাকেন বাংলা আর ইংরেজিও।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার দেওড়াছড়া চা-বাগানের বামনবিল টিলার একটি বাড়ির উঠানে চাটাই বিছিয়ে কুরুখ ভাষায় লেখাপড়া শিখছে ওঁরাং ক্ষুদ্র জাতিসত্তার একদল ছেলেমেয়ে। তারা সবাই এসেছে কুরুখ ভাষা শিখতে। তাদের ভাষা শেখাচ্ছেন আপন ওঁরাং। তাকে সহযোগিতা করছেন পাশের মিরতিংগা চা-বাগানের মিঠুন ওঁরাং। তারা দুজন একই কলেজের, একই শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাদের লক্ষ্যও এক। তারা মাতৃভাষার চর্চাকে গতি দিতে চান, সমৃদ্ধ করতে চান।
এ সময় কথা হয় শিক্ষাকেন্দ্রের উদ্যোক্তা আপন ওঁরাং ও মিঠুন ওঁরাংয়ের সঙ্গে। তারা জানান, ‘আমাদের পরিবারে মা-বাবা, মুরব্বিরা সব সময় কুরুখ ভাষায় কথা বলেন। কয়েকজন আছেন লিখতে পারেন, পড়তে পারেন; তবে শুদ্ধ করে বলতে পারেন না। আবার শিশু-কিশোর, যুবকদের অনেকে কুরুখ ভাষা জানে না, কথাও বলে না। নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই ভাষার চর্চা বাড়াতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
আপন তাদের পাঠদানের জন্য একটি স্থায়ী ঘরের দাবি জানিয়ে বলেন, ‘এক বছরের বেশি সময় ধরে নিজেরাই স্কুলটা চালিয়ে আসছি। এখন একটা ঘর দরকার। সরকারি সুযোগ-সুবিধা মিললে মাতৃভাষাকে, নিজেদের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখা সহজ হবে।’
কুরুখ ভাষার এই চর্চা সামনে আনার পেছনে আরও কাজ করেছেন কমলগঞ্জের লোকগবেষক আহমদ সিরাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানী সেলু বাসিত ও কুরুখ ভাষার গবেষক দীপংকর শীল। তারা এই ভাষার বই, অভিধান তৈরি করেছেন। এখানে যারা ভাষা শিখতে আসেন, তারা বিভিন্ন প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বর্তমানে ২৪-২৫ জন।
প্রসঙ্গত, দেওড়াছড়া চা-বাগানে ৩৭০ ওঁরাং জনগোষ্ঠীর লোক আছে। বামনবিল টিলায় আছে ১৫০ জনের মতো। পার্শ্ববর্তী মিরতিংগা চা-বাগানের হালকি টিলায় ৭০০ ওঁরাং জনগোষ্ঠীর বসবাস।
এই শিক্ষাকেন্দ্রে এসে কুরুখ ভাষার অনেক কিছু শিখেছেন বলে জানান নবম শ্রেণির ছাত্রী সীমা ওঁরাং। তিনি বলেন, ‘আগে আমরা কুরুখ ভাষায় বলতে পারতাম না। মা-বাবা নিজেদের মধ্যে কুরুখ ভাষায় কথা বলতেন। এখন নিজস্ব ভাষা শিখতে পেরে নিজেদের মধ্যে কুরুখ ভাষাতেই কথা বলতে পারি।’
কমলগঞ্জের লোকগবেষক আহমদ সিরাজ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বাংলাদেশে কুরুখ ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা নেই। কুরুখ ভাষায় লোকসংগীত, গল্প, ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন ইত্যাদির চর্চা আছে। ভাষাটি এখন বিপন্ন। ২০২২ সালের মার্চ মাসে আমার বাড়িতে ওঁরাং ভাষা শিক্ষার স্কুল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সে বছরই সেপ্টেম্বর মাসে বামনবিল টিলার লালসাই ওঁরাংয়ের বাড়িতে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে ক্লাস চালানো শুরু হয়। এ ভাষাটি টিকিয়ে রাখতে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।’
কুরুখ ভাষার গবেষক দীপংকর শীল বলেন, ‘কমলগঞ্জে ওঁরাং জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার। কুরুখ দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের একটি শাখা। ভাষাটি এখন বিপন্ন। কুরুখ ভাষা শিক্ষার জন্য ‘কুরুখ ভাষা শেখার প্রথম পাঠ’ রচনা করে দিয়েছি। আগামীতেও এই ভাষার বই, অভিধান তৈরি করব।’