× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

‘বালিশকাণ্ডের’ মজিদের কবলে রাজশাহী

রাজু আহমেদ, রাজশাহী

প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:০৩ এএম

আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:০৪ এএম

‘বালিশকাণ্ডের’ মজিদের কবলে রাজশাহী

রাজশাহীতে বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করছে রূপপুরের বালিশকাণ্ডের ঘটনায় সমালোচিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান আবাসিক হল নির্মাণ। গত মঙ্গলবার দুপুরে কাজ চলার সময় হঠাৎ ছাদের একাংশ ধসে পড়ে। এতে নয়জন শ্রমিক আহত হন। বের হয়ে আসে প্রকৌশল ত্রুটি ও অবহেলার কথা।

রাবির হল নির্মাণ ছাড়াও রাজশাহীতে আরও সাতটি প্রকল্পের কাজ করছে মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন। সব মিলিয়ে প্রায় ৫৫০ কোটি টাকার ৮ প্রকল্প। প্রতিটিতেই পাওয়া গেছে অনিয়ম ও ঢিলেমির অভিযোগ।

বুধ ও বৃহস্পতিবার মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশনের ৮টি প্রকল্প এলাকা ঘুরে ৫টি প্রকল্পে তাদের কার্যালয়ে তালা এবং কাজ বন্ধ থাকতে দেখা যায়। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজশাহী নগরীর বিমান চত্বরের কাছে নির্মাণাধীন ১০ তলা ওয়াসা ভবনের সামনে কথা হয় ওয়াসার সহকারী প্রকৌশলী আব্দুর রহীমের সঙ্গে। তিনি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে তার তিক্ত অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। 

আব্দুর রহীম বলেন, ওয়াসার নির্মাণাধীন ভবনে গোল্ডেন নামের একটি কোম্পানির রড নিয়ে এসে ঢালাই দেওয়ার কথা ছিল মজিদ সন্সের। কিন্তু রড দেখে সন্দেহ হয়। পরে রুয়েটে পরীক্ষা করানো হয় এবং দেখা যায় রডের মান অত্যন্ত নিম্ন। এরপর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে ওই রড দিতে নিষেধ করা হয়।

নির্মাণাধীন ওয়াসা ভবনের প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মো. মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হয় ২০২২ সালের জুন মাসে। কাজ শুরুর পর গত বছর (২০২৩) ম্যাট ঢালাইয়ের জন্য তারা গোল্ডেন কোম্পানির রড ব্যবহার করতে যায়। পিডব্লিউডির অনুমোদিত রডগুলোর মধ্যে ওই কোম্পানির রডের নাম থাকলেও আমাদের সন্দেহ হয়। তাই শতভাগ নিশ্চিত হতে আমরা তা পরীক্ষা করি। তবে পিডব্লিউডির নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে ওই রডের মান অনেক কম পাই।

প্রকল্প পরিচালক বলেন, নজরদারির কারণে অনিয়মের সুযোগ না পেয়ে কাজে ঢিলেমি করছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি। এতে করে সময়মতো প্রকল্প শেষ করা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

ঢাকার মহাখালী এলাকার নিউ ডিওএইচএসে অবস্থিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লি. রাজশাহীর গুরুত্বপূর্ণ চারটি প্রতিষ্ঠানে ৫৪৭ কোটি টাকার কাজ করছে। প্রজেক্টগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ৪৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজশাহী ওয়াসায় ১০ তলা ভবন নির্মাণ, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) ৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ তলা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ভবন, ৬৪.৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ইনস্টিটিউট ভবন নির্মাণ; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যলয়ে (রাবি) ১৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ তলা কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ভবন, ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ তলা এএইচএম কামারুজ্জামান হল নির্মাণ; রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) এলাকায় ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজীব চত্বরে ফ্লাইওভার, ৪১.৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে শালবাগান কাঁচা বাজার ও ৩৬.৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভদ্রা মার্কেট নির্মাণ।

গত মঙ্গলবার দুপুরে রাবির দুর্ঘটনার পর রুয়েট, ওয়াসা, রাসিকও সতর্ক হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। রুয়েটে চলমান প্রকল্পগুলোতে অন্যান্য ঠিকাদারের চেয়ে নিম্নমানের কাজের অভিযোগ রয়েছে এই ঠিকাদারের বিরুদ্ধে। জনবল ঘাটতির কারণে সময়মতো কাজ শেষ করা নিয়ে উদ্বেগও দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া তারা ১০ শতাংশ কম ব্যয় দেখিয়ে কাজ নিয়ে এখন তা বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে বলে ঠিকাদার সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন। 

রাসিক জানিয়েছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রজেক্টগুলোতে এই ঠিকাদার যে কাজ করছে সেখানে সার্বক্ষণিক প্রকৌশলী নিয়োগ করা থাকবে। ঠিকাদারের সরবরাহকৃত সিমেন্ট ও রডগুলো সর্বদা পর্যবেক্ষণ করা হবে। 

ওয়াসার প্রকল্পের পরিচালক মো. মাহাবুবুর রহমান বলেন, রূপপুরে বালিশকাণ্ডের পর আবার রাবি হলের ছাদ ধসের ঘটনার পর আমরা সতর্ক অবস্থায় রয়েছি। সর্বদা ওয়াসার একজন প্রকৌশলী ঠিকাদারের কাজ তদারকি করতে প্রকল্পে অবস্থান করছেন।

তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ১০ তলা ভবনের নির্মাণকাজের অগ্রগতি মাত্র ২৫ শতাংশ হয়েছে। যা কাজ শুরুর সময়ের অনুপাতে কম। অনিয়ম করার সুযোগ না পাওয়ার কারণে ঠিকাদার কাজে দেরি করছেন বলে মনে হচ্ছে। ঠিকাদারের কাজের যে গতি তাতে সময়মতো কাজ শেষ করতে পারা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এই আশঙ্কা থেকেই ঠিকাদারকে বারবার সতর্কতামূলক চিঠি প্রদান করা হয়েছে। কাজে বিলম্বিত হওয়ার কারণ হিসেবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান, নির্মাণসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির অজুহাত দেখাচ্ছে। এ পর্যন্ত একবার কাজের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। আরও একবার মেয়াদ বৃদ্ধি করতে চাচ্ছে তারা।

মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশনের প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার (ওয়াসার নির্মাণাধীন ভবন) সজিব মোল্লা বলেন, অন্য কোথায় কী হচ্ছে তা বলতে পারব না। তবে ওয়াসার ভবন নির্মাণে কোনো অনিয়ম হচ্ছে না। কাজের মেয়াদ আরও এক বছর আছে। তবে কাজ শেষ করতে সময় লাগতে পারে।

অভিযোগগুলোর বিষয়ে মজিদ সন্সের গুরুত্বপূর্ণ পদের কেউ কথা বলতে রাজি হননি। মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লি.-এর ওয়েবপেজে দেওয়া অফিসিয়াল টেলিফোন নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও কেউ রিসিভ করেননি। প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. আবু তালহার সঙ্গে কথা হলে তিনি কোনো মতামত দিতে রাজি হননি। এমনকি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কারও সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়েও কোনো সহযোগিতা করেননি তিনি। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক জার্জিসুর রহমানের নম্বরে একাধিকবার কল করে ও মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) প্রধান প্রকৌশলী শাহাদাৎ হোসেন বলেন, রুয়েটে মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লি. ছাড়াও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বিশ্বাসসহ অন্যান্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। ওইসব প্রতিষ্ঠানের কাজের মানের সঙ্গে তুলনা করলে মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশনের কাজ ধীরগতিতে চলছে। তাদের কাজও নিম্নমানের। 

তিনি বলেন, তারা কাজ পেয়েছে ইজিপির মাধ্যমে অংশগ্রহণ করে এবং সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে। এখন তারা দাবি করছে, নির্মাণসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির কারণে রেট বৃদ্ধি করতে হবে। এ ছাড়া তাদের জনবল ঘাটতি রয়েছে। এক প্রকল্পের মালামাল অন্য প্রকল্পে নিয়ে গছিয়ে দিতে চেষ্টা করে। আমরা এসব বিষয়ে সতর্ক রয়েছি।

রাসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. নূর ইসলাম বলেন, বালিশকাণ্ড এবং সম্প্রতি রাবিতে নির্মাণাধীন হলের ছাদ ধসের ঘটনার পর আমরা মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লি.-এর বিষয়ে সতর্ক অবস্থায় রয়েছি। সরকার তাদেরকে যেহেতু কালো তালিকাভুক্ত করেনি সেহেতু আমাদের কিছুই করার নেই। কাজের ক্ষেত্রে তাদের সিমেন্ট ও রডের মান নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের নিজস্ব প্রকৌশলী সার্বক্ষণিক তাদের কাজ তদারকি করছে। 

রাবির ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) শাহরিয়ার হাসান বলেন, নির্মাণাধীন শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান হলের ছাদের ধসে পড়া অংশটি ছিল ৩০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এবং ৬৯ ফুট প্রশস্ত। জটিল এই কাজে স্পেশাল কোয়ালিটির শাটারিং দরকার ছিল, যা দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া কনক্রিটের জমাট বাঁধতে সময় লাগে। কলাম ও বিম ঢালাইয়ের পর সেই সময়টাও দেওয়া হয়নি। ঢালাই শক্ত হওয়ার আগেই নতুন করে ঢালাই দেওয়া শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে এসব ত্রুটিই সামনে এসেছে। পাশাপাশি মিস্ত্রি ও শ্রমিকদেরও গাফিলতি থাকতে পারে। কাজের মেয়াদ নানা করণে পিছিয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর রাজশাহী জেলার সভাপতি আহমেদ শফি উদ্দিন বলেন, একটি শহরের অনেক বড় বড় নির্মাণ প্রকল্প কী করে একটি প্রতিষ্ঠান পেল তার তদন্ত হওয়া উচিত। এই ধরনের ঠিকাদারের পৃষ্ঠপোষকতায় ঠিকাদার সিন্ডিকেটের কোনো শক্তিশালী একটি চক্র থাকতে পারে। টেন্ডার পদ্ধতির মধ্যে কোনো রহস্য আছে কি না তা দেখা উচিত। কাজগুলো বুঝে নেওয়ার জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে তদারকি কমটি আছে কি না তা দেখা দরকার। যারা তদারকিতে ছিলেন তাদেরও আইনের আওতায় আনা উচিত। যে ঘটনা ঘটেছে তার জন্য উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমটি করা দরকার। দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডি যাতে আবারও না ঘটে সে কারণে এই কাজগুলো করা জরুরি।

প্রসঙ্গত, ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের একটি আবাসিক ভবনের ছাদ ধসে পড়ে। এতে ৩৯ জন ছাত্র, কর্মচারী ও অতিথি প্রাণ হারান।

সেই বালিশকাণ্ড

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের আবাসিক ভবনে (গ্রিন সিটি) আসবাবপত্র সরবরাহে অস্বাভাবিক দাম ধরে দুর্নীতি ও কেনাকাটায় অনিয়ম করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। সেখানে একটি বালিশের পেছনে ৬ হাজার ৭১৭ টাকা ব্যয় দেখানোর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া এ ঘটনা ‘বালিশ দুর্নীতি’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। 

২০১৯ সালের মে মাসে এই আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের নথি প্রকাশ করা হয়। তখন গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনস্থ পাবনা পূর্ত শাখার কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত পণ্য ক্রয়মূল্যের নথিতে উল্লিখিত ব্যয় নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সেই কেনাকাটার তালিকায় থাকা পণ্যগুলোর দাম বেশি পাওয়া যায়। ওই বছরের ডিসেম্বরে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ১৩ জনকে দুর্নীতির জন্য গ্রেপ্তার করে।

বাংলাদেশে একটি বালিশের বাজার মূল্য ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু প্রকল্পের অধীনে প্রতিটি বালিশের মূল্য দেখানো হয় বাজার মূল্যের প্রায় ২০ গুণ। আবাসন প্রকল্পের অধীনে নির্মিত ফ্ল্যাটে বালিশ তোলার খরচ হিসেবে দেখানো হয় ৯৩১ টাকা। খাট কেনার মূল্য ৪৩ হাজার ৩৫৭ দেখানো হয়েছে। প্রতিটি ডাইনিং টেবিল সেটের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৭৪ টাকা। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা