নুপা আলম, কক্সবাজার
প্রকাশ : ৩০ জানুয়ারি ২০২৪ ০৯:৪৫ এএম
আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:৪৯ এএম
প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তৈরি হচ্ছে অবকাঠামো। ২৫ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবারের ছবি
আইন ও সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে কংক্রিটের অবকাঠামো তৈরি অব্যাহত আছে। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করলেও থামানো যাচ্ছে না এই দৌরাত্ম্য।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) মতে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন ১৩ এলাকার (ইসিএ) একটি দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। আইন মতে, এই দ্বীপে এমন কোনো কাজ করা যাবে না যেখানে দ্বীপের পানি, মাটি, বায়ু বা প্রাণীর ক্ষতি করে। এখানে কোনো প্রকার অবকাঠামো নির্মাণও করা যাবে না। আর অবকাঠামো নির্মাণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্রও দিতে পারে না।
তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ২০২২ সালে সরকার ঘোষিত প্রজ্ঞাপন। যে প্রজ্ঞাপনে সেন্টমার্টিনকে মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া ঘোষণা করে সরকার। ঘোষণা অনুযায়ী এখানে ইট-সিমেন্ট আনা নিষিদ্ধ। শুধু বাঁশ-কাঠ দিয়ে পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো তৈরি করা যেতে পারে। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দ্বীপে একের পর এক অবকাঠামো তৈরি অব্যাহত রয়েছে।
২০২০ সালে সেন্টমার্টিনে এক জরিপ শেষে এনভায়রনমেন্ট পিপল নামে একটি পরিবেশবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জানিয়েছিল, দ্বীপটিতে ছোট-বড় ১২৩টি আবাসিক হোটেল ও কটেজ ছিল। এর মধ্যে আড়াই ডজনের বেশি ছিল দুই ও তিনতলা পাকা ভবন। তিন বছরের ব্যবধানে গত ডিসেম্বরে একই সংগঠনের জরিপে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে সেন্টমার্টিনে হোটেল, রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁর সংখ্যা আড়াই শতাধিক। ফলে দেখা যাচ্ছে, গত তিন বছরে নতুন তৈরি হয়েছে ১৩০টির বেশি অবকাঠামো।
সংগঠনটির প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, ‘ইসিএ বা মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া কাগজের ফাইলে বন্দি একটি বিষয়। এখানে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে প্রশাসন আন্তরিক নয়। প্রকাশ্যেই টেকনাফ থেকে নির্মাণসামগ্রী এনে একের পর এক অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। মাঝেমধ্যে প্রশাসনের লোকজন এসব স্থাপনা বন্ধে মৌখিক নির্দেশ দিয়ে থাকে, অভিযান চালায়। ক্ষেত্র বিশেষে মামলা করেন। এসবের পরও স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ হচ্ছে না।
গত ডিসেম্বরে যে অবস্থান দেখা গেছে এক মাসের ব্যবধানে সেই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দ্বীপে ২০টির বেশি স্থাপনা নির্মাণাধীন রয়েছে।’
রাশেদুল মজিদের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে মিলে যায় দ্বীপের সার্বিক পরিস্থিতি। যেখানে বর্তমানে অবাধে চলছে অবকাঠামো নির্মাণ। পরিবেশ অধিদপ্তর সাম্প্রতিক তদন্তে এরূপ ১২টি স্থাপনা নির্মাণের সত্যতাও পেয়েছে। গত ২৫ জানুয়ারি সেন্টমার্টিনের নির্মাণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মামলাও করে অধিদপ্তর।
পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া অবকাঠামো নির্মাণ ও সরকারের আদেশ অমান্য করার দায়ে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিদর্শক তদন্ত কর্মকর্তা ফাইজুল কবির বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় মামলা করেন।
মামলায় ১২ প্রতিষ্ঠান ও মালিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলোÑ ট্রফিকানা বিচ রিসোর্টের মালিক শেখ ফরহাদ, জলকুটি রিসোর্টের মালিক ড. মমি আনসারি, দক্ষিণা হাওয়ার মালিক ফেরদৌস সাগর, আরণ্যক ইকো রিসোর্টের মালিক মোহাম্মদ খাইরুল আলম, মেঘনা বিচ ভিউ রিসোর্টের মালিক মোশারফ হোসেন, ডিঙ্গি ইকো রিসোর্টের মালিক মোবাশ্বির চৌধুরী, জলকাব্য রিসোর্টের মালিক চপল কর্মকার ও চঞ্চল কর্মকার, গ্রিন বিচ রিসোর্টের মালিক আজিত উল্লাহ, সূর্যস্নানের মালিক ইমরান, স্যান্ড অ্যান্ড সেন্ড টুইন বিচ রিসোর্টের মালিক ইমতিয়াজুল ফরহাদ, নোঙর বিচ রিসোর্টের মালিক সাজ্জাদ মাহমুদ ও নীল হওয়ার মালিক আবদুল্লাহ মনির।
টেকনাফ থানার ওসি মুহাম্মদ ওসমান গণি জানিয়েছেন, পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিদর্শক তদন্ত কর্মকর্তা ফাইজুল কবির বাদী হয়ে দায়ের করা মামলাটি সংশ্লিষ্ট আইনে লিপিবদ্ধ করে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারকে তদন্তভার দেওয়া হয়েছে।
ফাইজুল কবির জানান, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে সরেজমিনে তদন্ত শেষে প্রমাণ পাওয়ার পর এই ১২ প্রতিষ্ঠানের ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
সরেজমিনে এ ১২ প্রতিষ্ঠান ছাড়াও দ্বীপে আরও অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ দেখা গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও স্থাপনা নির্মাণে জড়িতদের দেওয়া তথ্য বলছে, দ্বীপে সরকারি ও বিভিন্ন সংস্থার ৪-৫টি স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে। দ্বীপে এসব স্থাপনা তৈরির জন্য নির্মাণসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এই চক্রের কাছ থেকে উচ্চ মূল্যে সামগ্রী কিনে তৈরি হচ্ছে অন্যান্য স্থাপনাও। পুরো সিন্ডিকেটটি স্থানীয় চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। যদিও চেয়ারম্যানের ভাষ্য, ‘কোনোভাবেই আমি এর সঙ্গে জড়িত না।