প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৪ ২২:১৫ পিএম
আপডেট : ২৬ জানুয়ারি ২০২৪ ২২:২১ পিএম
তীব্র শীত উপেক্ষা করে কাজের সন্ধানে ছুটছে শ্রমজীবী মানুষেরা। ছবিটি শুক্রবার সকালে পঞ্চগড়ের সদর উপজেলার সিংপাড়া এলাকা থেকে তোলা। প্রবা ফটো
রাত ও দিনের পার্থক্যই যেন ভুলে গিয়েছিল পঞ্চগড়ের মানুষ। দেশের সর্ব উত্তরের এই জেলাটিতে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টির মতো টিপ টিপ করে ঝরছিল কুয়াশা। শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত বিরাজ করেছে এই অবস্থা। তারপর ধীরে ধীরে সূর্যের আলোর শুধু আভা দেখতে পাওয়া যায়। সন্ধ্যা থেকে আবার আগের অবস্থা শুরু হয়ে যায়। প্রায় একই অবস্থা উত্তরের আরেক জনপদ কুড়িগ্রামেও। সেখানেও সূর্য ঢাকা পড়ে থাকছে ঘন কুয়াশার আড়ালে। ঘড়ি না দেখলে বেলার আন্দাজ পাওয়া মুশকিল। গত কিছুদিন থেকেই দিনের একটা বড় সময় কেটে যাচ্ছে কুয়াশার আবছায়ায়। ফলে স্বাভাবিক জীবনযাপন দুরূহ হয়ে পড়েছে। শুক্রবার সকাল ১০টার পর কুয়াশা কমে গিয়ে আলোর দেখা মিললেও ঠান্ডার প্রকোপ কমেনি।
প্রতিদিনের বাংলাদেশের পঞ্চগড় প্রতিবেদক জানান, শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে তার দেখা হয় বোদা উপজেলার নলেহাপাড়া এলাকার দিনমজুর সুবল চন্দ্র রায়ের সঙ্গে। গলায় একটা ফুটোফাটা পুরোনো মাফলার প্যাঁচানো। গায়ে একটা শীতবস্ত্র আছে, তবে সেটার অবস্থাও শোচনীয়। শীতে জবুথবু হয়ে সুবল সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন কাজের সন্ধানে। কাজ যে পাবেন তেমন ভরসা পাচ্ছিলেন না মনে।
সুবল বলেন, পঞ্চগড়ে খুবই শীত। কুয়াশা আর বাতাসে হাত-পা কুঁকড়ে হয়ে যায়। ঘর থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু কাজ না করলে খাব কী? তাই বের হয়েছি। একই কথা জানালেন, খায়রুল ইসলাম ও এনামুল হক নামের আরও দুই খেটে খাওয়া মানুষ। কাঁধে মাটি কাটার ভার আর কোদাল নিয়ে ‘অন্ধকার’ ভোরে শহরে এসেছেন কাজের সন্ধানে। তাদেরও পরনে রংচটা জ্যাকেট, লুঙ্গি আর গলায় প্যাঁচানো মাফলার। শীতে কাঁপছিলেন ঠকঠক করে।
শুক্রবার সকালে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়ায় এ বছর দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সকাল ৯টায় সেখানকার তাপমাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা তীব্র শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে পড়ে। আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ৬ ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা নামলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। যেহেতু এক দিন হয়েছে এর জন্য এখনই এটিকে তীব্র বলা হচ্ছে না। শুক্রবার সকাল ৯টায় কুড়িগ্রামের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৬ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেটিকে গণ্য করা হয় মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে।
আবহাওয়াবিদরা যা বলছেন-
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম ও বরিশালে সামান্য বৃষ্টি হওয়ায় কুয়াশা কম ছিল। রংপুর ও রাজশাহীতে মেঘ ও কুয়াশাও কম ছিল। মেঘ থাকলে তাপমাত্রাটা ধরে রাখে। তাতে কিছু গরম থাকে। কিন্তু বৃহস্পতিবার যেহেতু মেঘ ছিল না তাই তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা এত কমে গিয়েছি। এতে শীত বেড়েছে। রাতে (শুক্রবার) সারা দেশে তাপমাত্রা ১ থেকে ২ ডিগ্রি কমবে।
দেশের এক অঞ্চলে তীব্র শীত, আরেক অঞ্চলে শীত কম থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বছর দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে তেমন বৃষ্টি হয়নি। যেহেতু এই অঞ্চলে বৃষ্টি কম হয়েছে তাই এ বছর কুয়াশা বেশি হচ্ছে। আবার যদি ভারতের বিহার, ওড়িশায় বৃষ্টি হতো তাহলেও আমাদের এ অঞ্চলে শীত কম হতো।
আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, তাপমাত্রা কম-বেশি হওয়ার মূল কারণ বাতাস। এখন দেখতে হবে বাতাস কোন দিক থেকে আসছে। এক. বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বায়ুচাপ কেমন ও তার আশপাশের বায়ুচাপ কেমন। এখন যেমন বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে উচ্চচাপবলয় আছে। এটি থাকার অর্থ হচ্ছে উত্তর-পশ্চিমে বাতাসের গতি বেশি ও দেশের অভ্যন্তরে চাপ কম। তাই উত্তর-পশ্চিমের ঠান্ডা বাতাস আমাদের দেশে প্রবাহিত হচ্ছে।
দুই. কুয়াশা বেশি থাকলে সূর্যের আলো আসতে পারে না। এতে শীত বেড়ে যায়।
তিন. সূর্যের আলো পেয়ে ভূপৃষ্ঠ গরম হলে পরবর্তী সময়ে আবহাওয়া গরম হয় কিন্তু এখন সূর্যের আলো ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত বেশি সময় আসতে ও থাকতে পারছে না।
চার. বাতাসে ভাসমান দূষিত কণার মান অর্থাৎ কোথাও দূষিত কণা তাপকে আটকে রাখে। যেখানে দূষণ কম সেখানে কুয়াশা কম পড়ে।
পাঁচ. রাত ও দিনের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে যাওয়া। তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির কম হলে শীতের অনুভূতি বেড়ে যায়। এটি ৫ ডিগ্রির নিচে এলে শীতের অনুভূতি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়।
তিনি বলেন, জানুয়ারি মাসে রাতে স্বাভাবিক গড় তাপমাত্রা থাকে ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি। দিনে স্বাভাবিক গড় তাপমাত্রা থাকে ২৫ দশমিক ২ ডিগ্রি। ১১ থেকে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত গড় তাপমাত্রা ৬ থেকে ১০ ডিগ্রি কম ছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তর শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে জানায়, চুয়াডাঙ্গা জেলা ও রংপুর এবং রাজশাহী বিভাগের ওপর দিয়ে যে মৃদু ও মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে চলছে তা আজ শনিবার আরও কয়েকটি জেলায় বিস্তার লাভ করতে পারে। শুক্রবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ২৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে কৃষির
এদিকে তীব্র শীতে পঞ্চগড়ে আলু, মরিচ, সরিষাসহ বোরো ধানের বীজতলার ক্ষতি হচ্ছে। ফসল বাঁচাতে কীটনাশক স্প্রে করছেন কৃষকরা। ফটিক চন্দ্র রায় নামে এক কৃষক বলেন, আলু, মরিচসহ বোরো ধানের বীজতলার বেশি ক্ষতি হচ্ছে। অনেক পরিমাণে কীটনাশক স্প্রে করেও ক্ষতি ঠেকানো যাচ্ছে না। আলুতে লেড ব্রাইট ধরেছে। গাছের পাতাগুলো হলুদ হয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। মরিচগাছেরও যেন চেহারা নেই। বেশি কীটনাশক স্প্রে করতে গিয়ে খরচও বেশি হচ্ছে।
বাড়ছে শীতজনিত রোগ
পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রামে এই মুহূর্তে শীতজনিত রোগীর সংখ্যাও অনেক বেশি। অবশ্য সারা দেশেই প্রতিনিয়ত বাড়ছে সর্দি, কাশিসহ নানা ধরনের অসুখ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের শুক্রবারের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৯৬৭ জন শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তার মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৩৪৮, ময়মনসিংহে ৬৯, চট্টগ্রামে ১৭৬, রাজশাহীতে ৭৩, রংপুরে ৯, খুলনায় ১৮০, বরিশালে ৪৩ এবং সিলেটে ৭৯ জন।
প্রতিদিনের বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম প্রতিবেদক জানান, সদর হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টায় শিশু ওয়ার্ডে ৭৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। এ ছাড়া ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ৪৩ জন। আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. শিপন বলেন, এই শীতে বাচ্চাদের সুষম খাবার দিতে হবে। সব সময় গরম কাপড় পরিয়ে রাখতে হবে। তাহলে ডায়রিয়া ও সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত কম হবে।