আ ন ম আমিনুর রহমান
প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৪ ১২:১৭ পিএম
আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০২৪ ১৪:১২ পিএম
সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের লেচুয়ামারা বিলে উড়ন্ত বামুনিয়া হাঁস। ছবি: লেখক
খোঁপাযুক্ত পরিযায়ী পাখিগুলোকে প্রথম দেখেছিলাম ১৯৯৮ সালে কানাডার অন্টারিও প্রদেশের ‘কোর্টরাইট ওয়াটার ফাউল পার্ক’-এ। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭-এ ওদের একেবারে কাছ থেকে দেখলাম ওদের নিজ দেশ যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামের একটি হ্রদে নীলশির (Mallard) ও লালমুড়ি (Common Pochard) হাঁসের সঙ্গে। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮-এ সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে পরিযায়ী হাঁসের খোঁজে ঘুরে বেড়ানোর সময় হাতিরগাতা কান্দার পাশে লেচুয়ামারা বিলে মাথায় টিকির মতো ঝুঁটিওয়ালা পাখিগুলোকে আবারও দেখলাম। মৌলভী হাঁসের (Red-crested Pochard) ঝাঁকের পেছন পেছন ভেসে বেড়াচ্ছিল ওরা। দেখতে চমৎকার লাগছিল। মাঝিকে বললাম ধীরে ধীরে ওদের পেছনে নৌকা ছোটাতে। প্রায় মিনিট পাঁচেক ছোটার পর ওদের বেশ কিছু ছবি তুলতে পারলাম।
খোঁপাযুক্ত কালো এই হাঁসগুলো এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান পরিযায়ী পাখি বামুনিয়া হাঁস। পশ্চিমবঙ্গে ওরা কালিহাঁস নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম Tufted Duck। অ্যানাটিডি বা হংস গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Aythya fuligula (অ্যাইথিয়া ফুলিগুলা)। ওদের মূল আবাস যুক্তরাজ্যসহ উত্তর ইউরেশিয়া। শীতে পশ্চিম ও দক্ষিণ ইউরোপ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় পরিযায়ী হয়।
প্রাপ্তবয়স্ক বামুনিয়া হাঁসা ও হাঁসির দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ৪২ থেকে ৪৮ ও ৩৯ থেকে ৪৪ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৬৫ থেকে ৭২ সেন্টিমিটার। আর ওজনে হাঁসা ও হাঁসি যথাক্রমে ৭৫৩ থেকে ১ হাজার ২৬ ও ৬৩০ থেকে ৯০৭ গ্রাম হয়। হাঁসা ও হাঁসির চেহারায় পার্থক্য রয়েছে। প্রজননকালে হাঁসার মাথা ও ঘাড়-গলা হয় ঘন কালো। মাথায় থাকে কালো বড় ঝুঁটি। বুক, পিঠ, লেজ ও লেজতল নীলচে-কালো দেখায়। পেট ও দেহতল সাদা। অপ্রাপ্তবয়স্ক হাঁসা এবং প্রজননকাল বাদে অন্য সময় প্রাপ্তবয়স্ক হাঁসার মাথা ও বুকের রঙ বাদামি-কালো, মাথার ঝুঁটি খাটো এবং থুতনি ও গলায় সাদা রঙ থাকে। অন্যদিকে হাঁসির মাথা, ঘাড়-গলা ও ঝুঁটি কালচে-বাদামি। পিঠ ঘন বাদামি। কপাল ও চঞ্চুর গোড়া কম-বেশি সাদা। দেহতল ফ্যাকাশে। হাঁসা-হাঁসি নির্বিশেষে চোখ হলদে। চঞ্চু নীলচে যার আগা কালো। পা ও পায়ের পাতা নীলচে-ধূসর।
শীতে এ দেশের মিঠাপানির জলাশয়, যেমনÑ হাওর, বিল, হ্রদ, নদী ইত্যাদিতে ওরা বিচরণ করে। সচরাচর মাঝারি ও বড় দলে দেখা যায়। অন্যান্য পরিযায়ী হাঁসের মিশ্র দলেও থাকে। দিবাচর ও সান্ধ্যচারী হাঁসগুলো পানিতে ডুব দিয়ে জলজ উদ্ভিদের কচি অংশ, শস্যবীজ, কীটপতঙ্গ ও শূককীট, চিংড়ি ও কাঁকড়াজাতীয় প্রাণী, ব্যাঙ, ছোট মাছ ইত্যাদি খায়। মাঝে মাঝে কর্কশ কণ্ঠে ‘হু-ওওও…’ এবং ওড়ার সময় শুষ্ক কণ্ঠে ‘গেরর..গেরর’ শব্দে ডাকে।
এপ্রিল থেকে আগস্ট প্রজননকাল। এ সময় মূল আবাস এলাকায় কোনো নির্জন দ্বীপে বা নদীতীরে বেশ গোপনে লতাপাতার বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৮ থেকে ১১টি, রঙ জলপাই-বাদামি বা জলপাই-ধূসর। ডিমে তা দেওয়া ও ছানা লালনপালনের দায়িত্ব হাঁসি একাই করে। ডিম ফোটে ২৩ থেকে ২৮ দিনে। শেষ ডিমটি ফোটার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছানারা বাসা ত্যাগ করে ও মায়ের পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। ছানাদের দেহে ৪৫ থেকে ৫০ দিনে ওড়ার পালক গজায় ও তারা স্বাবলম্বী হয়ে যায়। আয়ুষ্কাল ৭ থেকে ৮ বছর।
লেখক : পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ