সোনাগাজী (ফেনী) সংবাদদাতা
প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৪ ১৯:৫০ পিএম
দিন যায়, মাস যায়। চলে যায় বছর। কেনু মিয়াকে ফিরিয়ে নিতে আসে না কেউ। নিজের বা পরিবারের কারো ঠিকানাও বলতে পারেন না। নিজের নাম কেনু মিয়া, বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায়—শুধু এটুকুই বলে আসছেন বছরের পর বছর। মানুষের সহযোগিতায় কোনোমতে বেঁচে ছিলেন। অবশেষে এক সাংবাদিকের বাড়িতে ভাত চাইতে গেলে বদলে যায় তার গল্প। সাংবাদিক ফেসবুকে ভিডিও পোস্ট করলে প্রায় ২৮ বছর পর পরিবার তাকে খুঁজে পায়।
ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার ইসলামপুরের বাসিন্দারা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, গত ১৭ জানুয়ারি সকালে কেনু মিয়া স্থানীয় সংবাদকর্মী আবুল হোসেন রিপনের বাড়িতে গিয়ে ভাত খেতে চান। ভাত খাইয়ে সাংবাদিক কেনু মিয়াকে সাথে নিয়ে ভিডিও ধারণ করেন। সোনাগাজীর আলো নামক ফেসবুক পেজে পোস্ট করেন সেই ভিডিও। সেই দৃশ্যে কেনু মিয়াকে বাড়িতে ফিরে যাওয়ার আকুতি করতে দেখা যায়। ভিডিওটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়।
সাংবাদিক রিপন বলেন, ভিডিও পোস্টের পর ওই দিনই বিকালে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কানকোপাত ইউনিয়নের সাবেক সদস্য কাজি বেলাল ফোন করেন। তিনি ভিডিও কলে কেনু মিয়াকে দেখতে চান। সাংবাদিক রাতে কেনু মিয়াকে খুঁজে ভিডিও কলে কথা বলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু কেনু মিয়া অসংলগ্ন কথা বলতে থাকেন। ওই সময় বেলাল বলেন, ‘যাকে আপনারা কেনু মিয়া বলে চেনেন, সেটা তার আসল নাম না। তার নাম কাজি মাহবুব। সম্পর্কে তিনি আমার চাচা হন।’ পরদিন এক নারী নিজেকে কেনু মিয়ার মা ও এক ব্যক্তি কেনুকে নিজের ভাই বলে পরিচয় দেন। তারা সোনাগাজী এসে কেনু মিয়াকে ফিরিয়ে নিতে চান।
সাংবাদিক রিপন বলেন, তিনি গ্রামবাসীকে অবহিত করলে তারা সায় দেন। পরে রিপন ঘটনাটি সোনাগাজী থানার ওসি সুদ্বীপ রায় পলাশকে অবহিত করেন। ওসি ঠিকানা যাচাই করতে বলেন। কেনু মিয়াকে তার ভাই নিতে আসবেন এমন খবর জানাজানি হলে ইসলামপুরসহ আশপাশের এলাকায় মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়।
স্থানীয়রা জানান, শুক্রবার দুপুরে কাজি বেলাল ও কাজি বাবুল নামে দুই ব্যক্তি সোনাগাজী আসেন। তাদের একজন কেনু মিয়ার ভাই ও অপরজন চাচা বলে পরিচয় দেন।
ইসলামপুর গ্রামে সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কেনু মিয়া গত ১০ বছর ধরে আমাদের বাড়িতে বসবাস করছেন। পাগল হলেও তিনি আমাদের পরিবারের সদস্যের মতো ছিলেন। ভাই ও চাচাকে কাছে পেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকলে উপস্থিত মানুষের মধ্যে আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়।’
এর আগে কেনু মিয়া অন্য বেশ কিছু বাড়িতে আশ্রিত ছিলেন। তিন ২০০৪ সালে ইসলামপুরে আসেন বলে এলাকাবাসী জানান। মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও শান্ত স্বভাবের কেনু মিয়া সবার কাছে পেতেন আদর-ভালোবাসা।
কাজি বাবুল বলেন, ‘কেনুর আসল নাম কাজি মাহবুব। সে আমার বড় ভাই। আমাদের বাড়ি কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কনকাপৈত ইউনিয়নের পাঠানপাড়া গ্রামে। বাবার নাম কাজি ইউনুস ও মায়ের নাম মনোয়ারা। মাহবুব ১৯৯৪ সালে মানসিকভাবে অসুস্ত হয়ে পড়ে। আমরা চিকিৎসা করালেও কোনো উন্নতি হয়নি। ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায় মাহবুব। আমরা বহু খোঁজাখুজি করেও তারা সন্ধান পাইনি। আমরা ধরে নিয়েছিলাম সে মারা গেছে। সাংবাদিক ভাইয়ের ভিডিও দেখে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমার ভাই জীবিত আছে। পরে সোনাগাজীতে এসে ভাইকে দেখে বুঝতে পারলাম আমার ভাই এখনো জীবিত আছে। ভাইয়ের হারিয়ে যাওয়ার শোকে বাবা মারা গেছে, মা সব সময় আল্লার কাছে প্রার্থনা করত মৃত্যুর আগে যেন ভাইকে দেখার সুযোগ হয়। সাংবাদিকের কারণে আমার ভাইকে ফিরে পেলাম।’ কেনু মিয়াকে খাইয়ে-পরিয়ে ভালো রাখার জন্য গ্রামের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছে তার পরিবার।
শনিবার (২০ জানুয়ারি) বিকালে মুঠোফোনে কথা হয় কাজি বাবুলের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকার শত শত লোক ভাইকে দেখতে আসতেছে। ভাই এখন খুব বেশি কথা বলছে না। তবে মনে হয় সবাইকে আস্তে আস্তে চিনতে পারবে। মানসিক কিছু সমস্যা আছে বলে মনে হচ্ছে। যে কারণে ডাক্তার দেখাব বলে আমরা চিন্তা করছি। আমার বৃদ্ধ মা ভাইকে পেয়ে খুব খুশি। আমরা চিন্তাও করতে পারিনি এত বছর পর ভাইকে ফিরে পাব। ফেসবুকের কারণেই আমরা তাকে খুঁজে পেলাম। সবাই আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছে।’