ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার
প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:৪০ এএম
আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০২৪ ১৮:৩৪ পিএম
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার রূপসাগর গ্রামে ‘সীতেশ বাবুর চিড়িয়াখানায়’ দর্শনার্থীদের ভিড়। সম্প্রতি তোলা। প্রবা ফটো
গ্রামীণ নির্মল পরিবেশে খাঁচাবন্দি বন্য প্রাণীরা কেউ চিৎকার করছে, কেউ খুনসুটিতে মেতেছে। মেছো বাঘ বা মেছো বিড়াল, ভল্লুক, উল্লুক, ইমু পাখি, মায়া হরিণ, চিত্রা হরিণ, বিশালাকার অজগর, বানর, চশমা হনুমানসহ নানা প্রজাতির প্রাণীরা বিচরণ করছে নিজেদের মতো করে। পুকুরে দেশি ও পরিযায়ী পাখিরা জলকেলিতে ব্যস্ত।
প্রথম দেখায় মনে হতে পারে এটি একটি চিড়িয়াখানা। কিন্তু এটি চিড়িয়াখানা নয়, সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বন্য প্রাণীদের আশ্রয়কেন্দ্র। মৌলভীবাজারের চায়ের রাজধানী ও পর্যটন নগরী খ্যাত শ্রীমঙ্গল উপজেলার সদর ইউনিয়নের রূপসপুর গ্রামে এ আশ্রয় কেন্দ্রটির অবস্থান। স্থানীয়ভাবে এটি সীতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা নামে পরিচিত হলেও প্রকৃত নাম ‘বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন।’ প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ প্রাণীদের দেখা আর তাদের সঙ্গে পরিচিত হতে ভিড় করে এ প্রাণিরাজ্যে।
বর্তমানে বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনে রয়েছে অর্ধশতাধিক বিপন্ন ও বিরল প্রজাতির প্রাণী। উল্লেখযোগ্য প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে মেছো বিড়াল (যা মেছো বাঘ নামে পরিচিতি), ভল্লুক, উল্লুক, চশমা হনুমান, গাধা, লজ্জাবতী বানর, চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, ইমু পাখি, গন্ধগোকুল, অজগর, শঙ্খিনীসহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, সাধারণ প্রজাতির বানর, ধূসর বানর, সোনালি বিড়াল, বনবিড়াল, হিমালয়ান পাম সিভিট, হনুমান, বনরুই, গুইসাপ, বন্য শূকর, উড়ন্ত কাঠবিড়ালি, বোম্বেটিনকেট গ্লেইক, ধনেশ পাখি, কাছিম, পেঁচা, বাজ পাখি, শকুন, ময়নাসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।
১৯৬৫ সালে শ্রীমঙ্গল উপজেলার পশুপ্রেমিক শ্রীশ চন্দ্র দেব নিজ উদ্যোগে সদর ইউনিয়নের নেয়াগাঁও গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন বন্য প্রাণী আশ্রয়কেন্দ্র। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আশ্রয়কেন্দ্রটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ১৯৭২ সালে শ্রীশ চন্দ্র দেবের ছেলে সীতেশ রঞ্জন দেব তার আর কে মিশন রোডের বাসায় ক্ষুদ্র পরিসরে পুনরায় চালু করেন কেন্দ্রটি। পরবর্তীতে রূপসাপুর গ্রামে নিজের সাড়ে পাঁচ বিঘা জমির খামারবাড়িতে এটি স্থানান্তর করেন। সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে যার নামকরণ করেন বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বন ছেড়ে খাদ্য ও বাসস্থানের সন্ধানে লোকালয়ে আসা প্রাণীদের উদ্ধার করে নিবিড় পর্যবেক্ষণ, সেবা ও চিকিৎসা দিয়ে পুনরায় বনে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিবছর শত শত প্রাণীকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানসহ সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন সংরক্ষিত বনে অবমুক্ত করে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি। যে প্রাণীগুলো বনের পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারে না বা সুস্থ নয়, এমন প্রাণীদের এখানে রেখেই পরিচর্যা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সীতেশ রঞ্জন দেব বলেন, সেবা ফাউন্ডেশনে থাকা এসব প্রাণীর চিকিৎসাসেবা ও খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী খাদ্য সরবরাহ থেকে শুরু করে প্রাণীদের পুনরায় বনে ফিরিয়ে দেওয়া পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি বেশ ব্যয়বহুল ও জটিল প্রক্রিয়া। প্রাণীদের জন্য মাছ, মাংস, সবজি, কলা, দুধ ইত্যাদি কিনতে প্রতিদিন কয়েক হাজার টাকা প্রয়োজন। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে তা সংকুলান কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে এখানে আগত পর্যটকদের কাছ থেকে সামান্য প্রবেশ ফি নিলেও তা দিয়ে ফাউন্ডেশনটি পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। পারিবারিক মৎস্য খামারের আয় থেকে ঘাটতি পূরণ করতে হয়। সেবা ফাউন্ডেশনটি টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আবশ্যক।
বন্য প্রাণীদের টিকিয়ে রাখতে এবং চিকিৎসাসেবা দিতে সকলের ঐকান্তিক সহযোগিতা কামনা করেছেন সীতেশ রঞ্জন দেব।