টাঙ্গাইল-৫
হাসান সিকদার, টাঙ্গাইল
প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০২৪ ১৭:২৭ পিএম
আপডেট : ০৬ জানুয়ারি ২০২৪ ১৭:৩৮ পিএম
মামুন অর রশিদ ও ছানোয়ার হেসেন। প্রবা ফটো
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মামুন অর রশিদ। অন্যদিকে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ঈগল প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও বর্তমান সংসদ সদস্য ছানোয়ার হেসেন। এ আসনে তাদের দুজনের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে মনে করেন স্থানীয় ভোটাররা।
দলীয় নেতাকর্মী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে নির্বাচনী এলাকায় তৎপর ছিলেন মামুন অর রশিদ। শেষ পর্যন্ত তিনি সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেনকে টপকিয়ে মনোনয়ন পেয়ে যান। আর দলীয় মনোনয়ন থেকে ছিটকে পড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন ছানোয়ার হোসেন। জেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কিছু নেতা এবং জনপ্রতিনিধিরা তার পক্ষে কাজ করছেন। ফলে এ আসনে নির্বাচনী লড়াইয়ে ঈগল প্রতীক নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে নৌকার অনুসারীদের মধ্যে।
প্রচারণার শুরুর দিকে নৌকা ও ঈগলের সমর্থকের মধ্যে গুলি ও সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এসব কারণে জেলার অন্যান্য আসনের তুলনায় টাঙ্গাইল-৫ আসনে নির্বাচনী উত্তাপ সবচেয়ে বেশি। শুরু থেকেই সরগরম ছিল নির্বাচনের মাঠ। প্রার্থীরা ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়েও প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (রাত ৮টা) উভয় প্রতীকের কর্মী-সমর্থকদের দিনরাত গণসংযোগ করতে দেখা গেছে। পোস্টার সাঁটানো, মাইকিং, পাড়া-মহল্লায় গণসংযোগ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। এখন নির্বাচনে কে হচ্ছেন এই আসনের সংসদ সদস্য তা নিয়ে সর্বত্র চলছে নানা আলোচনা। তবে দুজনের মধ্যে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডিÑ এমনটাই মনে করছেন ভোটাররা।
নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। বিগত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হন ছানোয়ার হোসেন। নির্বাচনী এলাকা সদর উপজেলায় তিনি বহু উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পর তার পক্ষে কাজ করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান আনছারী, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুজ্জামান খান সোহেল, মহিলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দসহ কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা।
এদিকে বিগত ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন মামুন অর রশিদ। কিন্তু জোটের কারণে নির্বাচন থেকে সরে যেতে হয় তাকে। দল এবার তাকে মূল্যায়ন করেছে বলে মনে করেন তিনি। তার পক্ষে কাজ করছে জেলা, উপজেলা, পৌর ও বিভিন্ন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা। ফলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলা আওয়ামী লীগের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল তীব্র ও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় জেলা সদরের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত ‘খান পরিবার’। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহমদ হত্যা মামলার পর থেকেই কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এ পরিবারের রাজনীতি। তবে তাদের অনেক অনুসারী রয়ে গেছে। তারা নানাভাবে খান পরিবারের প্রভাবকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।
অপরদিকে খান পরিবারের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে জেলার আওয়ামী রাজনীতিতে যোগ হয়েছেন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মামুন অর রশিদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পৌরসভার সাবেক মেয়র জামিলুর রহমান মিরনসহ বহু নেতা। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছানোয়ার হোসেন খান পরিবারের অনুসারী হওয়ায় তাদের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছিলেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী খান পরিবারের মনমতো না হওয়ায় তাদের অনুসারীরা আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করছে বলেও একাধিক দলীয় নেতাকর্মী জানান। তবে ছানোয়ার হোসেনের প্রচার-প্রচারণায় তাদের (খান পরিবারের) কোনো প্রভাব দেখা যায়নি।
ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষরা বিভিন্ন অপবাদ ছড়াচ্ছেন। অতীতে এখান থেকে যারাই এমপি, মন্ত্রী হয়েছেন তাদের সঙ্গে ঢাকা গিয়ে কর্মীদের দেখা-সাক্ষাৎ করতে হয়েছে। আর আমি কর্মী ও জনগণের দোরগোড়ায় গিয়ে কড়া নাড়ি। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী উন্নয়মূলক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছি। শতভাগ সফল হয়েছি বলব না। তবে এই নির্বাচনে জয়লাভ করে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আসনটি আবারও উপহার দেব।’
মামুনুর রশিদ মামুনও টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে পরিচিত ও পুরোনো মুখ। টাঙ্গাইলে ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে বর্তমান কেন্দ্রীয় যুবলীগের নেতৃত্বদানের মধ্য দিয়ে দল ও কর্মীদের কাছে পরীক্ষিত নেতা। তিনি মাঝে বেশ কয়েক বছর রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে ঢাকায় আইন পেশায় সময় দেন। পরে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মনোনীত হন। দীর্ঘদিন টাঙ্গাইলের রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও মনোনয়নের আগে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও দলীয় সকল কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন।
মামুন অর রশিদ মামুন বলেন, ‘সাধারণ মানুষ পরিবর্তন ও উপযুক্ত প্রতিনিধি চাচ্ছে। দীর্ঘ ১৫ বছর আগে জননেত্রী শেখ হাসিনা টাঙ্গাইলে এসে একটি চারাগাছ বুনে গিয়েছিলেন, সেই চারাগাছ আমি। আমার সঙ্গে জনগণ আছে। জনগণের ভালোবাসায় ও নেত্রীর নির্দেশে সদর উপজেলার মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। বিজয়ী হলে এ উপজেলাকে মডেল হিসেবে গড়ে তুলব। সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত উপজেলা গড়ব।’
এদিকে বহুদিন ধরেই আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন টাঙ্গাইলের একসময়ের প্রভাবশালী সিদ্দিকী পরিবারের সদস্য মুরাদ সিদ্দিকী। তিনি এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাথাল প্রতীকে নির্বাচন করছেন। এর আগেও তিনি এ আসন থেকে ৫ বার নির্বাচন করেছেন। প্রতিবারই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোট পেয়েছেন। মুরাদ সিদ্দিকীর সমর্থকদের ধারণা তার প্রাপ্ত ভোট আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাপার বাইরের।
মুরাদ সিদ্দিকী বলেন, ‘জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে।আমি নির্বাচিত হলে টাঙ্গাইলে একটি ইপিজেড করব। যেখানে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। টাঙ্গাইল থেকে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ এবং নেশা উৎখাত করব। কারণ নেশাটা যুবসমাজকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যায়। স্বাস্থ্য সেবাসহ সাধারণ মানুষের চাওয়া ও জীবনমান উন্নয়ন করব।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, টাঙ্গাইল-৫ আসনেই বেশি নির্বাচনী আমেজ আছে। এখানে এলে বোঝা যায়, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হচ্ছে। দুই প্রার্থীর সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। আওয়ামী লীগের উপজেলা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কিছু নেতাকর্মী প্রকাশ্যে ও গোপনে ছানোয়ার হোসেনকে বিজয়ী করার জন্য সক্রিয়ভাবে সমর্থন দিচ্ছেন।
বিভিন্ন ইউনিয়নের নতুন ভোটাররা জানান, যিনি এলাকার উন্নয়ন, যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং গরিব-দুঃখীর পাশে দাঁড়াবেন তাকেই ভোট দিয়ে বিজয়ী করবেন। পৌর শহরের পূর্ব আদালত পাড়া, সাহাপাড়া, আদি টাঙ্গাইল, সাবালিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার ভোটাররা বলেন, খুব বিপদে পড়েছি। একজন নৌকা নিয়ে এসেছেন, আরেকজন বর্তমান এমপি। কে ভোটে উঠবে (জিতবে), তা বলা যাচ্ছে না। তবে নৌকা এবং ঈগলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
এ তিনজন ছাড়াও এ আসনে ভোটের মাঠে রয়েছেন জাতীয় পার্টির মোজাম্মেল হক (লাঙ্গল), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির হাসরত খান ভাসানী (একতারা), তৃণমূল বিএনপির শরিফুজ্জামান খান (সোনালী আঁশ), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তৌহিদুর রহমান চাকলাদার (নোঙ্গর), স্বতন্ত্র-খন্দকার আহসান হাবিব (কেটলি), জামিলুর রহমান মিরন (ট্রাক)। তাদের মধ্যে জামিলুর রহমান মিরন নৌকার প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, একটি পৌরসভা ও ১২টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত টাঙ্গাইল-৫ আসনের মোট ভোটার ৪ লাখ ৩৪ হাজার ১৯৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ১৭ হাজার ৪৭২। আর নারী ২ লাখ ১৬ হাজার ৭২২।