শরীফ স্বাধীন, মাগুরা
প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:১৫ পিএম
আপডেট : ০২ জানুয়ারি ২০২৪ ১৬:৪২ পিএম
মাগুরার ঢাকা রোড কাঁচাবাজার এলাকায় বৃহস্পতিবার গণসংযোগের সময় বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে সেলফি তোলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাকিব আল হাসান। প্রবা ফটো
সাকিব আল হাসান আগের চেয়ে এখন যেন একটু বেশিই ব্যস্ত। বলা ভালো- একটু নয়, মহাব্যস্ত এখন বাংলাদেশের এই মহাতারকা। উপলক্ষ নির্বাচন। অন্য কারও হয়ে নয়, সাকিবের মাঠে নামতে হয়েছে নিজের জন্যই ভোট প্রার্থনায়। সকাল থেকে দুপুর হয়ে সন্ধ্যা, তার যেন এতটুকুতেও ক্লান্তি নেই।
বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ৬টায় নিজের বাসা থেকে সাতদোহা, কসুন্দি হয়ে শ্রীপুর নির্বাচনী প্রচরণায় জনমানুষের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন সাকিব।
ব্যস্ত দিনে সাকিবের সঙ্গী ছিল তার হাইব্রিড মডেলের গাড়ি আর উৎসুক জনতা। সারা দিনে শহরের চারটি এলাকায় গিয়ে সাকিব চেয়েছেন ভোট। মাগুরা শহরের একতা কাঁচাবাজারে লিফলেট বিতরণ করেন। দোকানিদের সঙ্গে কথা বলেন। যোগ দেন সাতদোয়াপাড়ায় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতাদের সঙ্গে। এরপর কছুন্দি স্কুল মাঠ ও দারিয়াপুর স্কুল মাঠে নির্বাচনী জনসভায় যোগ দেন। সেখানে ভোটারদের আগামী ৭ জানুয়ারি সকালে কেন্দ্রে গিয়ে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে তাকে জয়যুক্ত করার আহ্বান জানান।
সাকিবকে হাতছোঁয়া দূরত্বে পেয়ে মাগুরা-১ আসনের ভোটাররাও যারপরনাই খুশি হয়ে পড়েন। সাকিবের সঙ্গে বিশাল জনসভায় অংশ নেন তারাও। কেউ তোলেন ছবি। কেউবা তাকে একবার ছুঁয়েও দেখতে চান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুই সদস্যের সঙ্গেও ছবি তুলতে দেখা যায় সাকিবকে। এ সময় সাকিবকে নির্বাচিত করার আশার কথাও শোনান তারা।
শীতের সকালেই বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছুট লাগান চৌরঙ্গী মোড়ের দিকে। হাতে লিফলেট, পায়ে স্পোর্টস জুতা, গায়ে কালো কোট আর মাথায় টুপি পরে প্রচারণা চালান। ভোর থাকতেই ৯ নম্বর ওয়ার্ডের হরিজন সম্প্রদায়ের কাছে আসেন সাকিব। তাকে দেখে মুহূর্তেই ভিড় জমে যায় এলাকাটিতে। টেলিভিশনে খেলতে দেখা বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডারকে কাছে পেয়ে আশার বাণী শুনিয়ে দেন বীথি রানী। হরিজন সম্প্রদায়ের ওই নারী বলেন, ‘তাকে তো টিভিতে বল খেলতে দেখি। এখন তো চেহারাটা একটু খারাপ হয়েছে। চিন্তার কারণ নেই আমরা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করব।’ সাকিবকে কাছে পেয়ে আবেদনের ডালি খুলে বসেন আরও কয়েকজন। সাকিব তাদের আশ্বাস দেন, নির্বাচনে জয়ী হলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাদের পাশে থাকবেন।
বাংলাদেশের তারকা অলরাউন্ডার মূলত একাই নির্বাচনী কাজে অংশ নেন। তার সঙ্গে তেমন কোনো রাজনৈতিক নেতাকর্মীকেও দেখা যায় না। এরপর ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সব এলাকায় গণসংযোগ করলেও সাকিবের সঙ্গে দেখা যায়নি ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। সেখানকার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ডাব্লু খান বলেন, ‘সাকিবের ব্যক্তিগত প্রোগ্রামের সঙ্গে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সমন্বয়ের অভাব হচ্ছে। যার কারণে তাদের সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মীদের দেখা যাচ্ছে না। আমরা জানতেও পারতেছি না কখন কোথায় কীভাবে সে প্রচার প্রচারণায় বের হচ্ছে।’
হরিজন সম্প্রদায়ের ওখান থেকে বের হয়ে সাকিব চলে আসেন হাসপাতালপাড়া হয়ে ঋষিপাড়ায়। আগে থেকেই সেখানে জড়ো হয়ে থাকা মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন, উপস্থিত দোকানিদের মাঝে প্রচারপত্র বিলি করেন। এরপর মাগুরায় প্রধান কাঁচাবাজারে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে হাত মেলান। সুযোগ পেয়ে সাকিবের কাছে আরজি রেখে দেন এক দোকানি। ব্যবসার কাজে সাকিব তাকে সাহায্য করার আশ্বাস দেন। কিন্তু নির্বাচনের পর সাকিব তাকে দেখা করতে অনুরোধ করেন। আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটের মাঠে যেতে সবাইকে অনুরোধ করেন সাকিব। সাড়ে ১০টার দিকে সাকিব তার নিজের হাইব্রিড গাড়িতে উঠে ইসলামপুরপাড়ার খালপাড়ের বাসিন্দাদের মাঝে নির্বাচনী প্রচার চালান।
খালপাড়ের বাসিন্দা খলিল মোল্লা আক্ষেপ করে প্রতিবেদককে বলেন, ‘এই শেষ দেখা আর কি দেখা হবে? রাজনীতিবিদরাই ভোট চাইতে আসেন। উনি তো বিশ্ব অলরাউন্ডার। আসবেন তো।’ সাকিব আশ্বাস দিয়েছেন তাদের মাঝে নির্বাচিত হয়ে আবারও আসবেন। তখন ঘড়ির কাঁটায় বেলা ১১টার মতো। হাঁটতে হাঁটতে সাকিবের কাছে জানতে চাওয়া হলো, কেমন হচ্ছে নির্বাচনী প্রচারণা? সাকিব ক্ষণিকের জন্য সময় পেয়ে বলেন, ‘নতুন নতুন এলাকায় যাচ্ছি ভোটারদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। বিষয়টি উপভোগ করছি।’
সকালে দুটি জায়গায় প্রচারণা শেষে সাকিব ১২টায় বের হয়ে হিন্দু ঐক্য পরিষদের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এরপর নিজের অফিসে কিছু সময় কাটানোর পর শহরের সাতদোহা ন্যাংটা বাবার আশ্রমের দিকে যান সাকিব। মাগুরা ও বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের বিজয়া পুনর্মিলনী ২০২৩ আয়োজিত অনুষ্ঠানের গেটে পৌঁছাতেই হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীরা উলুধ্বনি দিয়ে সাকিব এবং ডক্টর বীরেন শিকদারকে গ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সবাইকে নমস্কার জানিয়ে সাকিব বলেন, ‘আমি খুবই আনন্দিত আপনাদের মাঝে উপস্থিত হয়ে। আমি জানতে পারলাম এখানে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের একটি মিলন মেলা হচ্ছে। তাই আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে আসলাম। আমি খুবই আনন্দিত আপনাদের মাঝে এসে। ছোটবেলায় দেখেছি মাগুরার সব ধর্মের মানুষ তাদের আনন্দ উল্লাস একসঙ্গে পালন করে। সেটা ঈদ হোক পূজা হোক বা অন্য কোনো আচার-অনুষ্ঠান হোক। আমি সাহাপাড়ায় যেখানে বসবাস করি তার আশপাশে অনেক পরিবার আছে হিন্দু সম্প্রদায়ের। সেই পরিবারের অনেকেই আছে আমার বন্ধু। তাদের অনুষ্ঠানে আমি তাদের বাড়িতে গিয়েছি এবং আমার বাড়িতে ঈদের অনুষ্ঠানে তারা এসেছে। আমরা চাই মাগুরার মানুষ যেন একসঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারে। তাহলে সবাই শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।’
তখন মাগুরা জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব কুণ্ডুর সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ আ.লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্মল চ্যাটার্জি। এ ছাড়া হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাজেশ গোপালসহ আরও অনেকে। সবার কাছে ভোটের দিন উপস্থিত হয়ে তাকে নির্বাচিত করার আবেদন জানিয়ে সাকিব বলেন, ‘আপনারা আমার জন্য দোয়া ও আশীর্বাদ করবেন। আপনারা ভালো থাকবেন, শান্তিতে থাকবেন, আর আমি যেন আপনাদের মাঝে থাকতে পারি। আমি জানি আপনারা আমাকে হতাশ করবেন না। আমি কিছুই চাইব না। আমি চাই আপনাদের মাঝে বারবার ফিরে আসতে। সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন, জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।’
আশ্রম থেকে বের হয়ে সংসদ সদস্য বীরেন শিকদারসহ সাকিব রওনা হন বাড়ির উদ্দেশে। এরপর বেলা ৩টায় জেলা আওয়ামী লীগের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে কসুন্দি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের উদ্যোগে নৌকার নির্বাচনী প্রচারসভায় যোগ দেন। এবারের জাতীয় নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলের নেই কোনো প্রার্থী। আবার যার সাংগঠনিক ভিত্তি আছে এমন স্বতন্ত্র প্রার্থীও নেই মাঠে। যারা আছেন নিবন্ধিত দলের প্রার্থী হলেও তাদের নেই কোনো নিজস্ব দলীয় ভোট। স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনী মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন একাই দৌড়াচ্ছেন সাকিব। দলীয় নেতাকর্মীহীন তিনি একা হলেও বর্ণিল ক্যারিয়ারের কারণেই ভিড় হচ্ছে সাকিবকে দেখতে। যেখানে যাচ্ছেন, কৌতূহলী সাধারণ মানুষ তাকে অনুসরণ করছেন। জেলা আওয়ামী লীগ সাকিবের নির্বাচন প্রচারে নির্ধারিত কিছু কর্মসূচি প্রণয়ন করেই অনেকটা দায় সেরেছে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ফ ম আব্দুল ফাত্তাহ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘দলীয় নেতাকর্মীরা স্ব-অবস্থানে থেকে কাজ করছে এবং আমরা সাপ্তাহিক কর্মসূচি দিয়ে দিয়েছি সাকিবকে প্রচার প্রচারণা চালানোর জন্য। তাতে সমস্যা হচ্ছে এমনটা মনে হচ্ছে না।’
দুপুরে বাসায় ফিরে বেলা ৩টার দিকে সাকিব রওনা হন কসুন্দি ইউনিয়নের প্রচার জনসভায় যোগ দিতে। জনসভায় পৌঁছালে উপস্থিত সবাই সাকিবকে করতালির মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানান। জনসভায় বক্তব্যে সাকিব বলেন, ‘কসুন্দিবাসী কেমন আছেন আপনারা। আমি এই মাঠে আগেও এসেছি, আমি শুনেছি এখানকার মানুষ সব সময় নৌকায় ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে। আশা করি আমার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হবে না। মঞ্চে আমার সঙ্গে আছেন এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, সভাপতি ও সেক্রেটারিসহ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্যরা। আমি খুব বেশি কিছু চাইব না, আমি ভোটটা আশা করি। আমি চাই আপনাদের মাঝে থাকতে। আমাকে সুযোগ দিন। সেজন্য আমাকে দোয়া করবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে সুযোগ দিয়েছেন আপনাদের হয়ে কাজ করতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে ধারা অব্যাহত রয়েছে তারা যেন অব্যাহত থাকে। এই ধারা অব্যাহত রাখতে হলে নৌকার কোনো বিকল্প নেই। আমি আশা করি আগামী ৭ জানুয়ারি নৌকাকে বিজয় করবেন। আমাকে জয়যুক্ত করবেন, আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত করবেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতকে আরও শক্তিশালী করবেন।’
ক্রিকেট মাঠের ২২ গজের পিচে ১৭ বছর দৌড়ানো শেষ করার আগে সাকিব নেমেছেন জনতার দুয়ারে দৌড়াতে। মাগুরা-১ আসনের দুটি উপজেলার ২১টি ইউনিয়নের প্রায় ৪ লাখ ভোটারের কাছে খুব অল্প সময়ে পরিচিত হওয়া, ভোট নেওয়া এবং নির্বাচিত হওয়ায় চোখ সাকিবের। বিষয়টি চ্যালেঞ্জের হলেও সাকিব উপভোগ করছেন, ‘আমি এই নির্বাচনকে উপভোগ করছি। আশা করি সবাই আমাকে নির্বাচিত করবেন। আমি এমনিতেই ভাগ্যবান। ভাগ্য আমাকে দ্রুত ধরা দেয়।’