ঠাকুরগাঁও সুগার মিল
রহিম শুভ, ঠাকুরগাঁও
প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:৪১ পিএম
ঠাকুরগাঁও সুগার মিল। প্রবা ফটো
রংপুর বিভাগের মধ্যে একমাত্র সচল ও বৃহত্তর চিনিকল ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস। ১৯৫৮-৫৯ মৌসুমে মিলটি আখ মাড়াই কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে। এরপর থেকেই প্রায় প্রতিবছর লোকসানের বোঝা নিয়ে চলছে মিলটি। অন্যান্য বছরের মতো চলতি মৌসুমেও কাঙ্ক্ষিত আখ মাড়াই কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে সরবরাহ করা আখের মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। এতে তাদের আখ চাষে আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শতকোটি টাকা লোকসান ও আড়াইশ কোটি টাকার ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর চলতি আখ মাড়াই মৌসুমের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২৩-২৪ মৌসুমে চিনিকলে আখ মাড়াইয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭০ হাজার মেট্রিক টন। চিনি আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। সে হিসাবে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ৫৫০ মেট্রিক টন। আর রোপণ মৌসুমে দণ্ডায়মান আখের পরিমাণ ৪ হাজার ৬১০ একর জমি।
ঠাকুরগাঁও সুগার মিলের ২ হাজার ৮০০ একর নিজস্ব জমি রয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৪০০ একর জমি ব্যবহার করা হয় আখ উৎপাদনে। এ ছাড়াও বাইরের চাষিদের কাছ থেকে প্রায় ৫ হাজার ৮০০ একর জমির আখ আসে মিলটিতে। এখানে ১ হাজার ১৭৫ জন শ্রমিকের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত রয়েছে ৮৪৪ জন। এদের মধ্যে স্থায়ী শ্রমিক রয়েছে ৪৮০ জন এবং মৌসুমি শ্রমিক ৩৬৩ জন।
আখ চাষিদের অভিযোগ, আখের চাষ বাদ দিয়ে মিল কর্তৃপক্ষ জমিতে আলু, মিষ্টি কুমড়াসহ বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ করছে। অথচ আখ চাষ করতে চাপ দিচ্ছেন চাষিদের।
অন্যদিকে আখ সরবরাহের সময় অর্থ পরিশোধ না করায় হয়রানির শিকার হন চাষিরা। ফলে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন তারা। মিল কর্মকর্তাদের গাফিলতিতেই লোকসান আর ঋণের পাল্লা ভারী হচ্ছে বলে অভিযোগ চাষিদের।
সদর উপজেলার চিলারং ইউনিয়নের আখ চাষি কুতুব আলী বলেন, ‘তিন একর জমিতে আখ চাষ করছি। একসময় ইউনিয়নের প্রতিটি জমিতে আখ চাষ হতো। এখন আর কেউই আখ চাষ করতে চান না। কারণ ডিসেম্বরে মিল চালু হয়, তারপর রসিদ পাই। প্রতিদিন দিনমজুর নিয়ে আখ ঝুড়তে হয়, মাহেন্দ্র ভাড়া করে মিলে আখ পৌঁছে দিতে হয়। নিজের পকেট থেকে মজুরি দিতে হয়। আখ মিলে দিলে টাকা পাই দুই বা তিন মাস পর। এতে আমাদের চলতে ও সংসার চালাতে সমস্যা হয়। যদি আখ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টাকা পাওয়া যেত, তাহলে ভালো হতো। অনেকেই আবার আখ চাষে আগ্রহী হতেন।’
নারগুন ইউনিয়নের আখ চাষি জুনায়েদ কবির বলেন, আখ চাষ করি নিজের জমিতে। তবে ন্যায্যমূল্য পাই না। আর সুগার মিলের জমি লিজ দিয়ে আলু, সবজি, মুলা আবাদ করছে। মিল থেকে সার-ওষুধ পাইতাম। এখন তাও কমিয়ে দিয়েছে। তাই আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। কর্তৃপক্ষ চাষিদের দিকে সুনজর দিলে আমরা উপকৃত হতাম।
শিবগঞ্জ এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাজারে যেমন চিনির দাম বেশি সেই হিসেবে আখের দাম বাড়েনি। আমরা আখ চাষিরা চাই সময়মতো টাকা, সার, বীজ, কীটনাশক। তাহলে আখ চাষ আবার ফিরে আসবে এ জেলায়।’
মিলের কর্মচারী নাজমুল হক বলেন, ‘২০২০ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি শিল্প বাঁচাতে সাত দফা দাবি নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলাম সুগার মিলের কর্মচারীসহ ঠাকুরগাঁও জেলাবাসী। আন্দোলনের দাবিগুলো ছিলÑ ঠাকুরগাঁও চিনিকল লাভজনক করতে আধুনিকায়ন ও ডিস্টিলারি ইউনিট স্থাপন, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন, সুগার বিট প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন, শ্রমিকদের বকেয়া বেতন ও অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটির টাকা পরিশোধ, আখ চাষিদের টাকা সময়মতো পরিশোধসহ সারা বছর চিনিকল চালু রাখতে অশোধিত চিনি আমদানির অনুমতি দিয়ে পরিশোধন কারখানা স্থাপন। তবে কোনো দাবি মানা হয়নি। পুরোনো মেশিন বারবার মেরামত করে চালাতে হয়।’
সুগার মিলের আরেক কর্মচারী আব্দুল লতিফ বলেন, ‘আমরা ঠিকমতো বেতন পাই না। আখ চাষিদের টাকা সময়মতো পরিশোধ করতে পারেন না মিল পরিচালক। এতে আখের চাষ কমে যাচ্ছে। পুরোনো মেশিন দিয়ে আবার শুরু হলো আখ মাড়াই।’
সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহজাহান কবির লোকসান ও ঋণের কথা স্বীকার করে বলেন, বর্তমানে চিনির দাম ভালো থাকায় ঋণ ও লোকসানের বোঝা কমছে। চাষিরা আখ উৎপাদন বাড়ালে মিলটি ভালোভাবে চালিয়ে নেওয়া সম্ভব। তাদের দাবি-দাওয়া পূরণে চেষ্টা করছি।