× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

কুড়িগ্রামে প্রতিমন্ত্রী জাকিরের লুটপাটের চৌষট্টি কলা

রাশিদুল ইসলাম রাশেদ, কুড়িগ্রাম

প্রকাশ : ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ ০০:৪২ এএম

আপডেট : ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:৪৪ এএম

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। ছবি : সংগৃহীত

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। ছবি : সংগৃহীত

সংসদ নির্বাচনে কুড়িগ্রাম-৪ (রৌমারী, রাজিবপুর ও চিলমারী) আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়েও পাননি সংসদ সদস্য, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অসহায় পরিবারের ভূমি দখল এবং চাকরি ও বদলি বাণিজ্য করে অবৈধ অর্থের পাহাড় গড়ে তোলার অভিযোগে তার কপাল পুড়েছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। যদিও তার সন্ত্রাস ও লুণ্ঠনের শিকার কুড়িগ্রামের রৌমারী, রাজিবপুর ও চিলমারী উপজেলার মানুষজন এত আতঙ্কগ্রস্ত, কেউই তার ব্যাপারে সরাসরি মুখ খুলতে রাজি নয়। কেননা অভিযোগ রয়েছে, তার ভূমিডাকাতি এবং চাকরি ও বদলি বাণিজ্যের ব্যাপারে কেউ মুখ খুললেই মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়।

বঙ্গবন্ধু পরিবারের নাম ভাঙিয়ে ভূমি দখল

অভিযোগ রয়েছে, কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলায় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে জমি অধিগ্রহণ করা হয়। যার উদ্যোক্তা ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। কিন্তু পরে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন না করে তিনি তার ভাই জিল্লুর রহমানের নামে ‘জিল্লুর এন্টারপ্রাইজ’ নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করেছেন। একইভাবে সরকারি খাসজমি দখল করে শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে পরে সেই জায়গায় নিজের মায়ের নামে ‘সিরি রাইস মিল’ স্থাপন করেছেন এই প্রতিমন্ত্রী। 

অভিযোগ রয়েছে, একইভাবে রৌমারী উপজেলার যাদুরচর ইউনিয়নের সায়দাবাদ বাজারে বঙ্গবন্ধুর ছবি সংবলিত সাইনবোর্ড টাঙিয়ে প্রতিমন্ত্রী দখল করেছেন অসহায় শফিকুল ইসলামের জমি। চিলমারী উপজেলার বাঁধের মোড়ে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ’ সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দখল করেছেন বাবুর্চি আবুল বাশারের জমি।

প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন কর্তৃক লাঞ্ছিত ও জমির দখল হারানো সায়দাবাদ এলাকার শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নিরীহ মানুষ। মন্ত্রী আমার জমি দখল করলেও ভয়ে থানায় অভিযোগ পর্যন্ত করি নাই। ভয়ভীতি দেখিয়ে আমার জমির দখল করে রাখা হয়েছে। আমি এই বিচার কার কাছে চাইব?’ 

এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে প্রতিমন্ত্রী জাকির কুড়িগ্রাম-৪ আসনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। বঙ্গবন্ধু পরিবারের নাম ভাঙিয়ে তিনি দলের যে ক্ষতি করেছেন তা পূরণ হওয়ার নয়।’ 


মার্কেট নির্মাণের ধুম

অভিযোগ উঠেছে, রৌমারী উপজেলার কর্তিমারী বাজারে সরকারি জমি দখল করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন নির্মাণ করে চলেছেন পাঁচতলা মার্কেট। রাজিবপুর উপজেলা ডাকঘরের সামনের সরকারি পুকুর দখলের পর সেটি ভরাট করেও তিনি মার্কেট নির্মাণ করেছেন। রৌমারী সবজি বাজারে রাতারাতি নির্মাণ করেছেন ৮ হাজার স্কয়ার ফিটের ৫ তলা মার্কেট।

আপাতত বন্ধ বাড়ি নির্মাণের কাজ

গত ৯ ডিসেম্বর সরেজমিনে কুড়িগ্রাম পৌর এলাকার পালপাড়া গ্রামে গেলেই চোখে পড়ে প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের পাঁচতলা বিশিষ্ট নির্মাণাধীন ভবন। ভবনটির সামনে ঝুলানো হয়েছে প্রতিমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের ছবি সংবলিত সাইনবোর্ড। আশপাশের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাড়ির মালিক এখানে আসেন না বললেই চলে। জমি কেনাসহ সবকিছুই সারা হয়েছে কেয়ারটেকারের মাধ্যমে।

এদিকে পালপাড়া গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা হবিবর মিয়া বলেন, ‘মন্ত্রীর বাড়ির নির্মাণ কাজ কয়েকদিন থেকে বন্ধ দেখতেছি। শুনেছি মন্ত্রী নাকি ঝামেলায় পড়েছেন। তাই কাজকর্ম বন্ধ রেখেছেন।’


জমজমাট বালু ব্যবসা

প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের নামে রয়েছে অবৈধ ড্রেজার মেশিন বসিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে শতকোটি টাকার ভূগর্ভস্থ বালু তুলে ব্যবসার অভিযোগ। ঠিকাদার মীর হাবিবুল আলমের কাছে এক কোটি ২০ লাখ টাকার বালু বিক্রি করেন প্রতিমন্ত্রী। এভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রির অভিযোগ করায় উপজেলার বন্দবেড় ইউনিয়নের খঞ্জনমারা গ্রামের নুরল ইসলামের বিরুদ্ধে তিনি হয়রানিমূলক তিনটি মামলা করেন। রৌমারী, রাজিবপুর এবং চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্রের পাড় ঘেঁষে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে ভূগর্ভস্থ বালু উত্তোলন স্পটগুলোর অধিকাংশই রয়েছে প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের নিন্ত্রয়ণে।

ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ লুটপাট

অভিযোগ, রৌমারীতে প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের (পিটিআই) জমি অধিগ্রহণের সময় নিকটাত্মীয়দের নামে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে সরকারের দুই কোটি ৬৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই প্রতিমন্ত্রী। এ ছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে চিলমারী, রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নৌঘাট এবং হাট-বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিজের ভাই-ভাগনে ও নিকটাত্মীয়দের নামে কুক্ষিগত করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

আওয়ামী লীগের রৌমারী উপজেলা কমিটির এক সম্পাদক পদধারী ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মন্ত্রী নামে-বেনামে দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। নামে-বেনামে কেনা এসব জায়গা-বাড়ির মধ্যে রয়েছে রংপুরের বদরগঞ্জে ১৩ একর জমি, ঢাকার কাজলা এলাকায় ভাই রাশেদের নামে জমিসহ বহুতল বাড়ি, এপিএস আতিকুর রহমান রুবেলের নামে পিরোজপুরে কয়েক একর জমিসহ বিলাসবহুল বাড়ি, প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী শাহরিয়ার ইসলাম কল্লোলের নামে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে বাড়িসহ জমি ইত্যাদি।’ তিনি জানান, মন্ত্রী চর শৌলমারী ইউনিয়নে সোলার কোম্পানি প্রতিষ্ঠার নাম করে বাউন্ডারি দেওয়া আড়াই একর জমিতে নিয়মিত মাদকের আসর বসান। 

তবে ময়মনসিংহে জমিজমা এবং সম্পদ ক্রয়ের ব্যাপারে প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের ব্যক্তিগত সহকারী শাহরিয়ার ইসলাম কল্লোল বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী কর্তৃক আমার নামে জমিজমা এবং সম্পদ কেনার বিষয়টি ঠিক নয়। যিনি আপনাকে তথ্য দিয়েছেন তিনি সঠিক তথ্য দেননি।’

প্রতিমন্ত্রীর সহোদর রাশেদকে ফোন দিলে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে সব অভিযোগই ভুয়া। আমার নামে প্রতিমন্ত্রী ঢাকা কিংবা কুড়িগ্রামের কোথাও কোনো সম্পদ কেনেন নাই।’


চাকরি ও বদলি বাণিজ্য

পাশাপাশি চাকরি দেওয়া এবং বদলি করার নামে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের নামে। সম্প্রতি তিনি ৪৮ জন চাকরিপ্রার্থীকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়ার নামে ৬ কোটি টাকা উৎকোচ নেন। কিন্তু কাউকে চাকরি না দিয়ে উল্টো চাকরিপ্রার্থীদের ঢাকার বাসায় নির্যাতনের ঘটনায় আলোচিত ও সমালোচিত হন। 

রৌমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল আলম বাদল বলেন, ‘চাকরি, বদলি বাণিজ্য, মাঠঘাটসহ সবকিছুই এখন প্রতিমন্ত্রীর দখলে। গত ১০ বছরে উনি দলের কোনো নেতাকর্মীকে সুযোগ-সুবিধা দেননি। উনি দলকে পঙ্গু করে দিয়েছেন।’

প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ

এমন প্রেক্ষাপটে কুড়িগ্রামÑ৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ১৬ জন নেতা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনকে দলীয় মনোনয়ন না দিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ দেন। অভিযোগে প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনকে ‘মাদকাসক্ত, ভূমিদস্যু, দুর্নীতিবাজ, গণবিচ্ছিন্ন ও বিতর্কিত’ নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

প্রসঙ্গত, প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের জায়গায় এবার আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে দলের তথ্য ও গবেষণা উপকমিটির সদস্য বিপ্লব হাসান পলাশকে। তিনিও এই ১৬ অভিযোগকারী নেতার একজন। ১৬ অভিযোগকারী নেতাদের একজন রৌমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শহিদুল ইসলাম শালু। তিনি চিঠির বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘আমি আর অভিযোগ দিতে চাই না, আমি এখন স্বতন্ত্র এমপি প্রার্থী হয়েছি। আপনি পারলে অন্য কারো মন্তব্য নিন।’ অভিযোগকারীদের আরেকজন রাজিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই সরকার বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন তার আসনের নেতাকর্মীদের কোনো মূল্যায়ন করেন নাই। তার ওপর হাট-ঘাট, মাঠ, বালু উত্তোলন, টেন্ডারবাজি করে নিজের আখের গুছিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এবার যাকে মনোনয়ন দিয়েছেন, আমরা সবাই সর্বাত্মকভাবে কাজ করে তাকে বিজয়ী করব এবং প্রধানমন্ত্রীর হাতকে শক্তিশালী করব।’

এসব ব্যাপারে জানার জন্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে ফোনে মেসেজ পাঠালেও উত্তর পাওয়া যায়নি।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা