রহিম শুভ, ঠাকুরগাঁও
প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:২৫ পিএম
আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৮:২৭ পিএম
ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া থানার কশালগাঁও গ্রামে ধান কাটায় ব্যস্ত সুজন পাহান। সম্প্রতি তোলা। প্রবা ফটো
দিনমজুরির কাজ করলেও সুন্দর করে ইংলিশে কথা বলতে পারেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের ছেলে সুজন পাহান। ইংরেজিতে কথা বলার ভিডিও কন্টেন্টও নির্মাণ করেন। আর সেই সব ভিডিও কন্টেন্টের বদৌলতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এখন ব্যাপক পরিচিত সুজন।
আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়ের সুজন পাহানের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া থানার কশালগাঁও গ্রামে। সুজনের জন্মের দুই বছর পর মারা যান তার বাবা বগা পাহান। দুই বছরের শিশুপুত্রকে নিয়ে শুরু হয় মা দুলালী পাহানের নতুন এক জীবনসংগ্রাম। নিজস্ব বসতভিটা নেই তাদের। অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতেন তিনি। অভাব থাকলেও সুজনকে লেখাপড়ার জন্য পাঠান স্কুলে। কিন্তু সুজন যখন পঞ্চম শ্রেণিতে, তখন অসুস্থ হয়ে পড়েন দুলালী। তখন মায়ের দেখাশোনা আর ওষুধ কেনা থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব এসে পড়ে সুজনের কাঁধে।
এবার শুরু হয় সুজন পাহানের সংগ্রাম। মায়ের স্বপ্ন, লেখাপড়া করতে হবে তাকে। এদিকে বেঁচেও তো থাকতে হবে। তাই মাঠে খাটতে শুরু করেন তিনি। কৃষিকাজে যুক্ত হয়ে সুজনের অনেক সহপাঠীই ঝরে পড়েছে শিক্ষাজীবন থেকে। কিন্তু সুজন কষ্ট করে হলেও টিকে আছেন এখনও। সুজন বর্তমানে রুহিয়া ডিগ্রি কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে তৃতীয় বর্ষে ভর্তির অপেক্ষায় আছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, হাতে কাস্তে নিয়ে ফসলের মাঠে ধান কাটতে কাটতে, কখনও আবার গৃহস্থালির কাজ করতে করতে, চলতে ফিরতে শিশুদের নিয়ে সব সময় ইংরেজিতে কথা বলার চর্চা জারি রেখেছেন অদম্য সুজন। তার প্রতিবেশীরা ইংরেজি বুঝতে পারে না বলে অনেক সময় হাসি-ঠাট্টা করে তাকে পাগল বলে। তবুও ইংরেজিতে কথা বলার চর্চা থামাননি তিনি।
সুজন পাহানের মামা সুটকেস পাহান বলেন, আমার ভাগিনার বয়স যখন দুই বছর, তখন তার বাবা মারা যায়। আমি ওকে আর আমার বোনকে নিজের বসতভিটায় নিয়ে আসি। স্কুলে গিয়ে সে ইংরেজিতেও কথা বলতে শুরু করে। ইন্টারনেটে তাকে এখন সবাই চেনে। আমরা অনেক খুশি।
প্রতিবেশী বালা পাহান বলেন, সুজন যখন ইংরেজিতে কথা বলে, তখন বোঝাই যায় না যে, সে বাংলাদেশের ছেলে। আমরা সবাই অবাক হয়ে তার কথাবার্তা শুনি। এটা আমাদের সম্প্রদায়ের জন্য গৌরবের। সে অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করে। দিনমজুরি করে সংসার চালায়, মাকে দেখভাল করে।
সুজনের সহপাঠী নাজমুল সাকিব জানান, সুজন আমার ক্লাসমেট। বেশিরভাগ সময় সে কলেজে আসতে পারে না। মানুষের বাসায় কাজ করতে হয় তাকে। এখন ফেসবুকে প্রায়ই তার ইংরেজি বলা ভিডিও দেখতে পাই। তাকে নিয়ে আমরা তার ক্লাসমেটরা গর্ববোধ করি।
রুহিয়া ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক জাহাঙ্গীর বলেন, সুজন পাহানের ইংরেজি বলার ধরন অবাক করার মতো। সে এই কলেজের গর্ব। কলেজ থেকে সুজনকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
সুজন পাহান বলেন, স্মার্ট ও টেকনোলজির যুগে ভালো কিছু করতে গেলে বাংলা ভাষার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি শেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অভাব-অনটনের সংসারে পাঠ্যবই পড়ার সময় নেই। ভালো ইংরেজি শিখতে চাওয়াটা নিজের কাছেও কখনও কখনও অপ্রাসঙ্গিক লেগেছে। তবে প্রবল আগ্রহ ও ইচ্ছাশক্তির কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই। আমি ফেসবুকে ইংরেজিতে কথা বলার ভিডিও দেখেই ইংরেজি রপ্ত করার চেষ্টা করেছি এবং তা চর্চার ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করছি। কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ইংরেজি কোর্সও করিনি।
সুজন বলেন, সারা দিন ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করি। অনেকেই ভাবে আমার বুঝি মাথার সমস্যা দেখা দিয়েছে, কিন্তু আমি এসবের তোয়াক্কা করি না। মাঠে কাজ করে দিন চালাই। তবে একটি ছোট্ট চাকরি হলে স্বপ্ন পূরণে একধাপ এগোতে পারব।
দুলালি পাহান বলেন, আমার ছেলের ইচ্ছাশক্তি অনেক। যদি নিজে কাজ করতে পারতাম, তাহলে তাকে কখনও সংসারের এত চাপ নিতে হতো না।
সুজনকে একটি মোবাইল ফোন উপহার দেওয়া হয়েছে জানিয়ে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বেলায়েত হোসেন বলেন, উপজেলা প্রশাসন থেকে সুজনের বিকাশে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।