প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ ২০:৫৪ পিএম
আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ ২২:২১ পিএম
ভূমিকম্পে ফাটল ধরেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর বিভিন্ন স্থানে। প্রবা ফটো
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শনিবার (২ ডিসেম্বর) সকালে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে কুমিল্লায় হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে দুই শতাধিক পোশাকশ্রমিক আহত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এক শিক্ষার্থী হল থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন। এ ভূকম্পনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভবনে ফাটল ও হেলে পড়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ভোলার চরফ্যাশনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
এদিন সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে রিখটার স্কেলে হওয়া এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬।
হুড়োহুড়িতে শ্রমিক আহত হওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক-সংলগ্ন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ছুপুয়া এলাকায় অবস্থিত আমির শার্ট গার্মেন্ট লিমিটেডে। এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক আনোয়ার হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ভূমিকম্পের সময় আমাদের বেশিরভাগ শ্রমিক নিরাপদে নেমে যান। আচমকা ভিড় থেকে একজন বলে ওঠেন, ভবনে ফাটল। এ সময় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে নারী শ্রমিকদের মধ্যে হুড়োহুড়ি বেড়ে গিয়ে বেশ কয়েকজন আহত হন। প্রতিষ্ঠানের অ্যাম্বুলেন্সে করে অনেককে উপজেলা (চৌদ্দগ্রাম) স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘আহতদের চিকিৎসায় আমাদের একাধিক টিম কাজ করছে। এ পর্যন্ত কতজন আহত হয়ে এসেছে তাৎক্ষণিক সেটার সঠিক সংখ্যা বলা যাচ্ছে না। তবে এ সংখ্যা ২ শতাধিক হবে বলে ধারণা।’
চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি ত্রিনাথ সাহা বলেন, ভূমিকম্পে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে অনেকে আহত হয়েছেন বলে শুনেছি। আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি।
এদিকে ভূমিকম্পের ঘটনায় একইভাবে কুমিল্লা ইপিজেড ও কুমিল্লা মহিলা কলেজে আহত হয়ে চারজন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। হাসপাতালের পরিচালক আজিজুর রহমান সিদ্দিকী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষের দায়িত্বরত কর্মকর্তা এরশাদ হোসাইন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেছেন, তারা সারা দেশের কোথাও থেকে কোনো হতাহতের খবর পাননি।
রামগঞ্জ উপজেলার ভাদুর ইউনিয়নের সমেষপুর গ্রামের বাসিন্দা শেখ ফরিদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ভূমিকম্পের সময় আমি রামগঞ্জ শহরে ছিলাম। এজন্য কম্পনের বিষয়টি বেশি বুঝতে পারিনি। বাড়িতে এসে শুনেছি। আমাদের পুরো বিল্ডিং কেঁপে উঠেছে। এ ধরনের ভূকম্পন আমাদের এলাকায় আর দেখা যায়নি।’
এদিকে ফেনী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের ওয়্যারহাউস ইন্সপেক্টর ওয়াসি আজাদ বলেন, ‘বেলা ১১টা পর্যন্ত কোথাও কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।’
ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল লক্ষ্মীপুরে
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস বলছে, রামগঞ্জ উপজেলা থেকে আট কিলোমিটার পূর্ব ও উত্তর-পূর্বে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। রামগঞ্জ উপজেলার ভাদুর ইউনিয়নের হানুবাইশ গ্রামে ভূকম্পন উৎপন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়া দপ্তরের এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সকাল ৯টা ৩৫ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে ৫ দশমিক ৬ রিখটার স্কেলে মাঝারি আকারের ভূকম্পন হয়েছে।
রামগতি প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের পর্যবেক্ষক সোহরাব হোসেন বলেন, রামগঞ্জে ভূকম্পনের উৎপত্তি হয়েছে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে আমাদেরকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে।
ভাদুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাবেদ হোসেন বলেন, ‘আমি শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ খাট নড়ে ওঠে। পুরো বিল্ডিংটাই নড়ছিল। এ ধরনের ভূমিকম্প গত কয়েক বছরে দেখিনি। গণমাধ্যমে জানতে পেরেছি, আমাদের হানুবাইশ গ্রামে ভূকম্পনের উৎপত্তিস্থল। তাৎক্ষণিক স্থানীয় ইউপি সদস্য মামুন হোসেনের সঙ্গে কথা বলেছি। কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবু খোঁজ নেওয়া হয়েছে।’
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ভূমিকম্পটি রামগঞ্জ থেকে উৎপত্তি হয়েছে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে। কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। তবু রামগঞ্জ ইউএনওসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের খোঁজ নিতে বলা হয়েছে।’
ঢাবির হল থেকে লাফিয়ে পড়ে শিক্ষার্থী আহত
মাস্টারদা সূর্যসেন হলের দ্বিতীয় তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে মো. মিনহাজুর রহমান নামে এক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। ওই শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে তিনি নিচে লাফিয়ে পড়েন।
পরে আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
মাস্টারদা সূর্যসেন হলের প্রিন্সিপাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার মো. আব্দুল মোতালেব বলেন, ‘ভূমিকম্প আতঙ্কে ওই শিক্ষার্থী লাফ দিয়েছিল। তবে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। তার পায়ে প্লাস্টার করা হয়েছে। কয়েকদিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে, যদি হাড় জোড়া না লাগে, তাহলে সার্জারি করা লাগতে পারে।’
ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া জানান, মিনহাজকে ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে।
ভূমিকম্পে কুবির আবাসিক হলে ফাটল
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, কাজী নজরুল ইসলাম হল এবং নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হলের দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা।
সরেজমিন দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু হলের ২০৯ নম্বর কক্ষের দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া ৫০৪ নম্বর কক্ষের সামনের করিডোরের মেঝের দুটি টাইলস উঠে গেছে। একই তলায় নতুন ও ব্লকের সংযোগস্থলের করিডোরে নতুন ফাটল দেখা গেছে। পাশাপাশি দক্ষিণ ব্লকের দুই করিডোরের মাঝের সংযোগস্থলে পাঁচতলাব্যাপী ফাটল ধরেছে। এ ছাড়া নজরুল হলের দোতলার ২০৭ নম্বর কক্ষের দেয়ালে, টিভি রুমের সামনের পিলারের সংযোগস্থলে নতুন ফাটল দেখা গেছে।
মোতালেব নামের নজরুল হলের একজন আনসার সদস্য বলেন, আমি নিচতলা, দুইতলা ও তিনতলায় ফাটল দেখে এসেছি। এগুলো আগে ছিল না।
হলগুলোর প্রভোস্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান।
বঙ্গবন্ধু হলের প্রভোস্ট সহযোগী অধ্যাপক তোফায়েল হোসেন মজুমদার সরেজমিন ফাটল পরিদর্শন করে জানান, দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরে কথা বলব বিষয়টি দেখার জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) মো. আবদুল লতিফ বলেন, যদি স্ট্রাকচারাল কোনো সমস্যা হয় তবে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলে দ্রুত ব্যবস্থা নেব। ভূমিকম্পের কারণে স্ট্রাকচারাল কোনো সমস্যা হয়, তবে তা অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। এই বিষয়ে আমরা নিজেরা খোঁজ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
নোবিপ্রবির তিনটি হলে ফাটল
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (নোবিপ্রবি) তিনটি হলের ফাটল দেখা দিয়েছে, তবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
ভাষাশহীদ আব্দুস সালাম হলের ৪০৮, ৪১৬ নম্বর কক্ষে, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক উকিল হলের ৩০৬, ৩১১ নম্বর কক্ষে এবং বিবি খাদিজা হলের ২১১ নম্বর কক্ষের দেওয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. নয়ন আহমেদ বলেন, ‘এটাকে বলা হয় হেয়ার ক্র্যাক। দেওয়াল থেকে প্লাস্টার আলাদা হয়েছে। তবে কোনো স্ট্রাকচারালের ক্ষতি হয়নি। তাই বলা যায় কোনো ধরনের ঝুঁকি তৈরি করবে না। দ্রুত এসব ফাটল মেরামত করা হবে।’
প্রক্টর আনিসুজ্জামান বলেন, ভূমিকম্পের ফলে আমাদের তিনটি হলের বিভিন্ন কক্ষে ফাটল ধরা পড়ে। ঘটনার পর প্রকৌশলীরা স্থানগুলো পরিদর্শন করেছেন। এগুলো মেজর বা ঝুঁকিপূর্ণ কিছু না। দ্রুতই সমাধান করা হবে।
চরফ্যাশনে আতঙ্ক
ভূমিকম্পে চরফ্যাশনে আতঙ্কে রয়েছে স্থানীয়রা। ভোলার চরফ্যাশনে হঠাৎ ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এতে আতঙ্কে রয়েছে চরফ্যাশনবাসী। তবে উপজেলার কোথাও কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি বলে জানান উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ সালেক মুহিদ।
উপজেলা সদরের স্টুডিও ব্যবসায়ী মো. ইউসুফ বলেন, ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার দোকানঘরটি কেঁপে ওঠে।