× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

যশোর রোডের মৃত গাছে পাঁচ বছরে ১২ মৃত্যু

তরিকুল ইসলাম মিঠু, যশোর

প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৩ ১০:৪৩ এএম

আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০২৩ ১১:০৭ এএম

যশোরের বেনাপোলের ৩৮ কিলোমিটার শতবর্ষী রেইনট্রিগুলোর অধিকাংশই মৃত। সম্প্রতি তোলা। প্রবা ফটো

যশোরের বেনাপোলের ৩৮ কিলোমিটার শতবর্ষী রেইনট্রিগুলোর অধিকাংশই মৃত। সম্প্রতি তোলা। প্রবা ফটো

শত শত মুখ হায় একাত্তর যশোর রোড যে কত কথা বলে/এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে’-মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের বিখ্যাত ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতার লাইন দুটি মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ঐতিহাসিক এই সড়ক ধরে লাখো বাংলাদেশি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল।

যশোর রোড আরও একটি কারণে বিখ্যাত, এর দুই পাশের কয়েকশ রেইনট্রির জন্য, যা যশোরের ঐতিহ্যও বটে। তবে শতাব্দী প্রাচীন এই গাছগুলোর বেশিরভাগ এখন মৃত-অর্ধমৃত। বর্তমানে সেগুলো এক ধরনের মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। এই রোডের দুই পাশে শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজারো শিক্ষার্থী ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছে। অবিলম্বে ঝুঁকিপূর্ণ গাছগুলো অপসারণের দাবি জানিয়েছে স্থানীয়রা।

ভারতের দমদম থেকে বাংলাদেশের যশোর পর্যন্ত বিস্তৃত সড়কটি বাণিজ্যিক সড়ক হিসেবে দুই দেশের জন্যই গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু বাংলাদেশ অংশের যশোর-বেনাপোলের ৩৮ কিলোমিটার সড়কে শতবর্ষী রেইনট্রিগুলোর অধিকাংশই মৃত, বেশকিছু অর্ধমৃত। এসব গাছ, গাছের কাণ্ড, ডাল যানবাহনে চলাচলকারী এবং পথচারীদের ওপর ভেঙে পড়ে গত পাঁচ বছরে অন্তত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অনেকে। 

সর্বশেষ চলতি বছরের ১৭ আগস্ট রাতে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বেনেয়ালি ব্র্যাক অফিসের সামনে ডাল ভেঙে বাসের ছাদে পড়লে সালাউদ্দিন (৪৫) ও শিমুল হোসেন (৩৫) নামে দুজনের মৃত্যু হয়। নিহত সালাউদ্দিন যশোর উপশহর ডি ব্লকের লিয়াকত আলীর ছেলে ও শিমুল বেনাপোল বড় আঁচড়া গ্রামের মুনছুর আলীর ছেলে।

যশোর-বেনাপোল মহাসড়কে আছে ৬৯৭টি শতবর্ষী রেইনট্রি। যার মধ্যে ৪৫৩টিরও বেশি মৃত। আরও কিছুসংখ্যক অর্ধমৃত। সরেজমিনে দেখা যায়, যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের ঝিকরগাছার মল্লিকপুর ধেভড়িপাড়া থেকে নাভারণ পুরাতন বাজার পর্যন্ত শতবর্ষী অন্তত ১৫টি বড় শিশুগাছ মহাসড়কের মাঝ পর্যন্ত হেলে রয়েছে। এতে বড় কাভার্ডভ্যান ও অন্যান্য পরিবহন চলাচল করতে পারছে না। এর মধ্যে মল্লিকপুর ধেভড়িপাড়া, কীত্তিপুর পালপাড়া, হাজিরালী মহিলা কলেজ মোড়, বালিখোলা, বেনেয়ালী, গদখালী ফুলবাজার, নবীবনগর মোড়, কলাগাছি, নাভারণ কলোনিপাড়া এবং নাভারন পুরাতন বাজার এলাকায় সড়কের ওপরেও গাছ হেলে রয়েছে। এসব স্থানে আরও ২০টি মরা গাছের নিচ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে মানুষ ও যানবাহন চলাচল করছে।

এ ছাড়া রাস্তা সংকীর্ণ হওয়ায় গাছের কারণে দুই লেনে যান চলাচলেও সমস্যা হচ্ছে। রাতে এই সড়ক দিয়ে সচরাচর মালবাহী ভারী যানবাহন চলাচল করে। এসব ভারী যানের প্রচণ্ড গতি ও সংঘর্ষে গাছের শুকনো ডাল, ভগ্নাংশ ও অর্ধমৃত গাছের ডাল ভেঙে পড়ে অন্যান্য বাহনের ওপর। যার কারণে এই সড়কে গাছের ডাল পড়ে দুর্ঘটনা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গতি ও সংঘর্ষ ছাড়াও ঝড়ো বাতাসেও ভেঙে পড়ছে গাছ কিংবা গাছের ডাল। 

গাছ পড়ে নিহত শিমুল ছিলেন মোটর শ্রমিক। তার স্ত্রী রানুর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, আমার স্বামী বাসের হেলপার ছিলেন। গাছ পড়ে রাস্তায় নির্মমভাবে তার মৃত্যু হলেও সরকারের পক্ষ থেকে এমনকি বাসমালিক সমিতির পক্ষ থেকেও কোনো খোঁজ নেওয়া হয়নি। এখন ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছি।

যশোর-বেনাপোল সড়কের বাসচালক বাবু বলেন, ওপরে গাছের ডাল ও নিচে সড়কের মধ্যে ঢুকে পড়েছে গাছের শিকড়। বামপাশ দিয়ে চলাচলের কথা থাকলেও গাছের সঙ্গে বাসের অংশ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কায় কখনও কখনও রং সাইডে ঢুকে পড়তে হয়। এ সময় অপর পাশ থেকে দ্রুতগতিতে গাড়ি এলে বিপদে পড়তে হয়। প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে এ সড়কে গাড়ি চালাতে হয়।

আরেক বাসচালক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এই রাস্তায় গাড়ি চালানো বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। বেনাপোল থেকে ছেড়ে আসা দূরপাল্লার পরিবহন ও বন্দর থেকে ছেড়ে আসা মালবাহী ট্রাক পাশ কাটাতে গিয়ে অধিকাংশ সময় বাসের ওপরের অংশে হেলে পড়া গাছগুলোয় আটকে যায়। এ সময় গাছের ডাল ভেঙে বাসের ছাদে ও আশপাশের ছোট যানবহনের ওপর পড়ে। এতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। 

২০১৮ সালে যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক সংস্কারের জন্য দুই পাশের গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেয় জেলা পরিষদ। কিন্তু পরিবেশবাদী সংগঠন ও সচেতন নাগরিক সমাজের আন্দোলনে গাছ কাটা নিয়ে বিভক্তির সৃষ্টি হয়। এরপর উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞায় গাছ কাটা বন্ধ হয়ে যায়। যেটি এখনও নিষ্পত্তি হয়নি।

এ বিষয়ে যশোর রোড উন্নয়ন ও গাছ রক্ষা সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক খন্দকার আজিজুল হক মনির বলেন, আমরা সাধারণ মানুষের পক্ষে। গাছগুলো চলাচলে সমস্যা তৈরি করছে। তাই নিরাপত্তার জন্য মৃত ও অর্ধমৃত গাছ কেটে জীবিত গাছগুলো রাখা হোক।

নাভারণের আকিজ কলেজিয়েট স্কুলের প্রিন্সিপাল এনামুল কাদির শামীম বলেন, প্রতিদিন জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে যশোর থেকে মোটরসাইকেলে কলেজ আসি। মনে হয় এই বুঝি গাছের ডাল ভেঙে মাথায় পড়ল। এ রাস্তা ব্যবহারকারী সবাই মনে এ ধরনের শঙ্কা নিয়ে চলাচল করে। রাস্তার জীবিত গাছ নিয়ে আমাদের অভিযোগ নেই। জনকল্যাণের কথা বিবেচনা করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাস্তার দুই ধারের এসব মৃত ও অর্ধমৃত গাছগুলো অপসারণ করা জরুরি।

ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, গাছগুলো শুধু ঝুঁকিপূর্ণই নয়, বিপজ্জনকও বটে। বন্দর থেকে মালবাহী কন্টেইনার ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান প্রতিদিনই গাছে আটকে যায়। ৪০ মিনিটের রাস্তা পার হতে সময় লাগছে দুই ঘণ্টার বেশি। জাতীয় স্বার্থেই ঝুঁকিপূর্ণ গাছ অপসারণ করে মহাসড়ক সম্প্রসারণ করা জরুরি। 

যশোর জেলার বিভাগীয় বন সংরক্ষক কর্মকর্তা আবুল কালামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই। জেলা প্রশাসক ও জেলা পরিষদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি। 

জেলা পরিষদ যশোরের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল বলেন, পাঁচ বছর আগে গাছগুলো কাটার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরিবেশবাদীদের বিরোধিতা ও উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞায় গাছ কাটা বন্ধ হয়ে যায়। মামলাটি নিষ্পত্তি হলে প্রাণহীন গাছগুলো অপসারণ করা হবে।

যশোরের সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ বলেন, যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক উন্নয়নের প্রকল্প উপস্থাপন করা হয়েছে। খুব দ্রুতই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে। আশা করছি এর আগেই হাইকোর্টের মামলাটি নিষ্পত্তি হবে। তখন গাছ অপসারণে কোনো বাধা থাকবে না।

উল্লেখ্য, কালীগঞ্জের জমিদার কালীপোদ্দার ১৮৪০ সালে যশোর থেকে কলকাতা এই রাস্তাটি নির্মাণ করে দু’পাশে রেইনট্রি রোপণ করেন। দেশ ভাগের পর ৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কিছু অংশ বাংলাদেশে পড়ে। এই সড়কে যশোর থেকে বেনাপোল পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার শতবর্ষী গাছ ছিল। কয়েক দশক আগের এক জরিপে ২ হাজার ৩৫০টি গাছ পাওয়া যায়। যার অধিকাংশই এখন মৃত বা মৃতপ্রায়। এই গাছগুলো অপসারণের মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষের চলাচল নিরাপদ করার দাবি সকলের।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা